সোমালিয়ার জেলে গুলা কেন জলদস্যু হল বিস্তারিত
১৯৯১ সালে সোমালিয়ায় সংঘাত শুরু হওযার পর
থেকে দেশটির কেন্দ্রে কোন শক্তিশালি সরকার
আসেনি৷ জুন ২০০৪ সালে দেশটিতে অন্তবর্তিকালীন
কোয়ালিশন সরকার গঠিক হয়। পাঁচ বছরের
মেয়াদে তাদের লক্ষ্য ছিল একটি অন্তর্বতিকালীন
সংবিধান রচনা করা। ২০০৮ সালে তারা একটি নতুন
খসড়া সংবিধান প্রনয়ন করে কিন্তু সেটা নিয়েও
প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।
সেই বিরোধের জের ধরে প্রধানমন্ত্রী ওমর আব্দুর রশিদ
আলী শারমার্ক পদত্যাগ করেন।
গৃহযুদ্ধের কারনে ভেঙে পড়ে দেশটির অর্থনীতি।
কৃষি শিল্পসহ সমগ্র ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হয়।
এমতবস্থায় নতুন দুর্যোগ হিসেবে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। দেশটির
কয়েক কোটি মানুষ ভয়াবহ দুভিক্ষে আক্রান্ত হয়। লক্ষ লক্ষ
মানুষ খাবারের আশায় আর বাচাঁর জন্য
পাশ্ববর্তি দেশে উদ্বাস্তু হয়ে পালিয়ে যেতে থাকে।
একদিকে দুভিক্ষ আর অন্যদিকে গৃহযুদ্ধের
কারনে দেশটি এক রকম নরকে পরিনত হয়। ব্যার্থ
রাষ্ট্রে পরিনত হয় সোমালিয়া।
রহস্যময় জাহাজের আনাগোনা :
এমনই জগাখিচুড়ি যখন সোমালিয়ার অভ্যান্তরিণ
পরিস্থিতি তখন সেই সুযোগে দেশটির
উপকূলে আনাগোনা শুরু হয় রহস্যময় ইউরোপীয় জাহাজের।
তারা চুরি করে সোমালিয়ার উপকূলে প্রবেশ করে,
এবং তড়িঘড়ি করে সাগরে বিরাট বিরাট ব্যারেল
ফেলেই পালিয়ে যায়। তাত্ক্ষণিকভাবে উপকূলের
অধিবাসীরা বুঝতে পারে না সেগুলোতে কি আছে।
বোঝাগেল তখনই যখন তারা অসুস্থ হতে শুরু করলো।
প্রথমে তাদের গায়ে অদ্ভুত সব দাগ দেখা দিতে শুরু করে,
তারপর শুরু হলো বমি। সবচেয়ে মারাত্তক বিষয়
হলো নারীরা বিকলাঙ্গ শিশু প্রসব করতে থাকলো।
বোঝা গেল তেজষ্ক্রিয়তার কারনে এসব হচ্ছে।
রোগাক্রান্ত হয়ে শত শত মানুষ মারা যেতে থাকলো।
২০০৫ সালের পর, সোমালিয়ার উপকূল ভরে যায় হাজার
হাজার পরিত্যক্ত ও ফুটো ব্যারেল। পানি বিষাক্ত
হওয়ার কারনে মরে যেতে থাকলো মাছ। সোমালিয়ায়
জাতিসংঘ প্রতিনিধি আহমেদু আবদাল্লাহ বলেন, ‘কেউ
আমাদের উপকূলে পারমানবিক বর্জ ফেলছে। আরও
ফেলছে সীসা, ক্যামিয়াম ও মার্কারি। নেই
সাথে বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান।’ প্রায় ১০ মিলিয়ন
টন বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য তাদের উপকূলে ফেলা হয়।
তদন্ত করে দেখা গেল এসব আসছে ইউরোপের হাসপাতাল,
কারখানা আর পারমানবিক চুল্লি থেকে।
এমনকি তারা বর্জ ফেলার জন্য মাফিয়াদেরও
ভাড়া করে। ইউরোপীয় সরকারগুলো এবিষয়ে নিশ্চুপ।
তারা এসব বর্জ ফেলা প্রতিরোধ করছে না, বিরতও
থাকছে না, দিচ্ছে না কোন ক্ষতিপূরণ।
একই সময়ে অন্য কিছু ইউরোপীয় দেশগুলোর জাহাজ
সোমালিয়ার সমুদ্র লুটপাট শুরু করে। সোমালিয়ার প্রধান
সম্পদ তাদের সামুদ্রিক মাছের ভাণ্ডার। সোমালিয়ার
সমূদ্র উপকূল থেকে তারা প্রতিবছর ৩০০ মিলিয়ন ডলারের
টুনা, চিংড়ি, গলদা চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ
ধরে নিয়ে যায়।
শুরু হলো প্রতিরোধ :
সমূদ্রে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ
করে যে জেলে সম্প্রদায় তারা বুঝতে পারলো এবার
তাদের সর্বস্ব খোয়া যেতে বসেছে। মোহাম্মদ হোসেন
নামে এক যুবক বলে, ‘যদি কিছুই করা না হয়, অল্পদিনের
মধ্যেই আমাদের সমুদ্র মাছহীন
হয়ে পড়বে।’তারা ভাবলো বিছু একটা করা দরকার। তখন
তারা প্রথমে স্পিডবোট নিয়ে বর্জ্র্য ফেলা ও মাছ ধরার
জাহাজ আর ট্রলারগুলিকে তাড়িয়ে দেওয়ার
চেষ্টা করে। এভাবেও যখন পারা গেল না তখন
একপর্যায়ে তাদের ওপর ‘ট্যাক্স’ বসানোরও
চেষ্টা করে জেলেরা। কিন্তু তাতেও তাদের
ঠেকানো গেল না। এক পর্যায়ে একরকম বাধ্য হয়েই
তারা হাতে তুলে নিল অস্ত্র। মাছ চুরি করা আর বর্জ
ফেলা জাহাজগুলোকে তারা দখল করে নিতে শরু করলা।
তারা বুঝতে পারলো জাহাজগুলি দখল করা যায়। এই
সাধাসিধা জেলেরা এবার হয়ে উঠলো ‘জলদস্যু’।
তাদের এক নেতা সুগুল আলি বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য
হলো বেআইনী মাছ ধরা এবং উপকূল পারমানবিক ও
রাসায়নিক বর্জ ফেলা বন্ধ করা।…আমরা জলদস্যু নই…ওরাই
জলদস্যু যারা আমাদের মাছ কেড়ে নেয়, যারা আমাদের
সমুদ্র বিষ দিয়ে ভরে ফেলে এবং আমাদের
পানিতে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করে।’
স্থানীয়দের কাছে এই ‘জলদস্যু’রা বিপুলভাবে জনপ্রিয়।
সোমালিয়ার একটি সংবাদ সংস্থার
জরিপে উঠে আসে বিস্ময়কর তথ্য। ৭০ ভাগ সোমালিয়
মনে করে ‘জলদস্যুতাই এখন তাদের সমুদ্র প্রতিরক্ষার
জাতীয় কৌশল।
দস্যু বৃত্তির সূচনা :
বর্জ ফেলা জাহাজ আটকের মধ্য দিয়ে তাদের
আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেল। তাদের মধ্য সুযোগ
সন্ধানী একটি অংশ কৌশল পরিবর্তন করলো। জাহাজ ও
নাবিকদের আটক করে মুক্তিপণ আদায় জলদস্যুদের বড়
কৌশল হয়ে দাঁড়ালো। এবার
তারা হয়ে উঠলো সত্যিকারের জলদস্যু। এর মধ্যে অনেক
জাহাজ আটক করে নাবিকদের জিম্মি করা হয়েছে।
সোমালিয়ার সরকার গোটা দেশের নিয়ন্ত্রণ
নিতে ইসলামী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
জলদস্যুতা রোধে তারা খুবই অসহায়। গৃহযুদ্ধ আর
জঙ্গি দমনে সরকার এত বেশি ব্যাস্ত আর বিপর্যস্ত
যে জলদস্যু দমন তাদের সামর্থের বাইরে।
সেই সুযোগে সোমালিয়ার বিশাল উপকূলীয়
এলাকা জলদস্যুদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হলো।
তারা এতটাই দুধর্ষ জলদস্যুতে পরিণত হলো যে, দুনিয়ার বড়
বড় শিপিং কোম্পানিগুলো আর সরকারের ঘুম হারাম
করে দিতে থাকলো। বিশেষ
করে যারা ব্যাবসা বানিজ্যের জন্য আরব সাগর আর
লোহীত সাগর ব্যাবহার করে তাদের জন্য। এই
রুটটি হয়ে উঠলো পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল জলপথ।
সমুদ্র নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন,
সোমালিয়ায় মাত্র পাঁচটি জলদস্যু দল এবং তাদের
অধীনে ১২ শ’র বেশি বন্দুকধারী জলদস্যু আছে।
তারা লোহিত সাগরের দক্ষিণাংশে চলাচল
করা বিদেশী জাহাজকে ধরতে সমুদ্রে মাছ ধরা নৌযান
ব্যবহার করে। মাছ ধরা ট্রলারের
ছদ্ববেশে তারা সাগরে অবস্থান করে আর সুযোগ
বুঝে বানিজ্যিক হাজাজে হামলা করে। রাতের
বেলা বড় বড় জাহাজগুলোকে বেপরোয়াভাবে আক্রমণ
করে তারা। হেভি মেশিনগান এবং রকেট প্রপেলড
গ্রেনেড দিয়ে সূত্রপাত হয় সেই সব আক্রমণের।
এ কাজে তারা অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার
করে। ব্যবহার করে রকেটচালিত গ্রেনেড। এছাড়াও
তারা ব্যবহার করছে মোবাইল ফোন, স্যাটেলাইট ফোন,
জিপিএস, সোলার সিস্টেম, আধুনিক স্পিডবোট, অ্যাসল্ট
রাইফেল, শটগান, গ্রেনেড লঞ্চারসহ অত্যাধুনিক সরঞ্জাম।
গভীর সাগরে মাদারশিপ এবং সেখান
থেকে পরিচালিত স্পিডবোট, ভারী যন্ত্রপাতি,
স্যাটেলাইট ইকুইপমেন্ট, এবং মুক্তিপণের জন্য
বিদেশে মধ্যস্থতাকারী নিয়ে কারবার এখন তাদের।
আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) হিসাবমতে,
২০০৬ সালে জলদস্যুদের ২৩৯টি হামলার ঘটনায় ৭৭ নাবিক
অপহৃত হয়েছেন, জিম্মি করা হয়েছে ১৮৮ জনকে। নিহত
হয়েছেন ১৫ জন। ২০০৭ সালে জলদস্যু হামলা ১০ শতাংশ
বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬৩-তে। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ
হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। ২০০৯ সালের
প্রথম ৯ মাসে ছিল আগের বছরের চেয়েও বেশি। এ সময়
সবচেয়ে বেশি হামলা হয়েছে এডেন সাগর ও
সোমালিয়া উপকূলে। ২০০৫ সালের
নভেম্বরে সোমালিয়া উপকূলে আক্রান্ত হয়
একটি মার্কিন ক্রুজ শিপ।
জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী গত বছর গালফ অব
এডেনের করিডোরে ১১১টি আক্রমণ হয়েছে, যা আগের
বছরের তুলনায় ২০০ গুণ বেশি। ইন্টারন্যাশনাল ম্যারিটাইম
ব্যুরো জানাচ্ছে যে, বিশটারও বেশি দেশের
নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজের উপস্থিতি সত্ত্বেও গালফ
অব এডেনে গত বছরে আক্রমণের
সংখ্যা হচ্ছে ৫১টি জাহাজ। প্রায় এক হাজার নাবিক
তারা জিম্মি করে রেখেছে।
জলদস্যুদের এড়িয়ে বানিজ্য
জাহাজগুলি পরিচালনা করা এক কথায় অসম্ভব। কারন
এশিয়ার দেশগুলো উইরোপের সাথে বানিজ্য
করতে চাইলে ভারত ও আরব উপসাগর দিয়ে সুয়েজ খাল
অতিক্রম করেই কেবল ভূমধ্য সাগরে পৌছানো সম্ভব। আর এই
পথে জাহাজগুলিকে সোমালিয়ার উপকূল অতিক্রম
করতেই হবে। আর একটি পথ আছে ইউরোপ থেকে পূর্ব ও
দক্ষিণ এশিয়ায় পৌছানোর ভস্কো দা গামার আবিস্কৃত
উত্তামাশা অন্তরিপ। কিন্তু এতো পথ ঘুরে বানিজ্য
করতে গেলে ব্যাবসায়ে লালবাতি জ্বলার সম্ভাবনাই
বেশি।
আর এ কারনেই জলদস্যুদের এড়ানোটা প্রচণ্ড রকমের ব্যয়বহুল
হয়ে পড়েছে শিপিং কোম্পানীগুলোর জন্য।
মোম্বাসা বন্দরের হারবার মাস্টার তালিব খামিস
বলেন যে, জলদস্যুদের এড়ানোর জন্য গালফ অব এডেন
থেকে মোম্বাসা যাওয়ার জন্য সব জাহাজকেই
অতিরিক্ত দুই দিন সময় নিতে হচ্ছে ঘুরপথে আসার জন্য।
এছাড়া এই এলাকায় চলাচলকারী জাহাজের
ইনশিওরেন্সের প্রিমিয়ামও হয়ে উঠেছে অনেক উচ্চ।
কাজেই জাতিসংঘের সশস্ত্র পাহারা ছাড়া কোন
শিপিং কর্পোরেশনকে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে তাদের
বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে জাহাজ ভাড়া দেওয়ার জন্য
রাজি করানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
তবে এই জলদস্যু সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ
হচ্ছে সোমালিয়া নিজেই। সোমালিয়ার আট মিলিয়ন
লোকের মধ্যে আড়াই মিলিয়ন লোকই সাগর
দিয়ে আসা খাদ্যের উপর নির্ভরশীল।
মোম্বাসা থেকে মোগাদিসু পর্যন্ত জাতিসংঘের
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের
খাদ্যবাহী জাহাজগুলোকে ফরাসী, ডেনিশ এবং ডাচ
যুদ্ধজাহাজগুলো এসকোর্ট দিচ্ছে অনেকদিন ধরেই। কিন্তু
তা সত্ত্বেও এই সাপ্লাই লাইন সবসময়ই বিপদজনক এবং ভঙ্গুর
রয়ে গেছে। গত বছরের মে মাসে সোমালিয়ার জন্য
চিনি বয়ে নিয়ে যাওয়া জর্ডানিয়ান জাহাজ
ভিক্টোরিয়াকে মোগাদিসুর ৩৫ মাইল দূর
থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। একসপ্তাহ
পরে ছাড়া পায় সেই জাহাজ।
‘জলদস্যু’ বানিজ্য :
সেমালিয়াতে জলদস্যুতা এখন বিশাল
বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। দুবাই এবং অন্যান্য
দেশে থাকা সোমালিরা বিনিয়োগ করছে এই ব্যবসায়
বিপুল পরিমাণে। সোমালি জলদস্যুদের লুট করা টাকায়
বন্দর ঈলে বিশাল বিশাল ভিলা এবং হোটেল
তৈরি হয়ে গেছে। এক সময়কার গরীব জেলেরা এখন
মার্সিডিজ বেঞ্জ হাকাচ্ছে। শুধুমাত্র ২০০৮ সালেই
সোমালিয়ান জলদস্যুরা আয় করেছে একশ পঁচিশ মিলিয়ন
ডলার। বিশাল মুনাফার কারণে সোমালিয়ার অনেক
যুদ্ধবাজ গোত্র নেতারাই সুসংগঠিত উপায়ে শুরু
করেছে জলদস্যু ব্যবসা। দলে দলে দরিদ্র
জেলে ছেলেরা জলদস্যু দলে নাম লেখানোর জন্য
উঠে পড়ে লেগেছে। এই ব্যবসার আসল
লোকজনেরা রয়েছে পর্দার অন্তরালে। অন্যসব ব্যবসার মতই
সম্মুখসারির জলদস্যুদের হাতে টাকার খুব সামান্য অংশই
যায়। বেশিরভাগ অংশটাই চলে যায় নেপথ্যের
হোমড়া চোমড়াদের কাছে।
অভিযোগ রয়েছে সোমালিয়ার সেনাবাহিনী,
কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রি ও নেতারা এমন কি ইউরোপ
আমেরিকার অনেক বড় বড় ব্যাবসায়ি এই লুটের টাকার
ভাগ পেয় থাকে। এছাড়াও যুদ্ধবাজ গোষ্ঠি নেতারা ও
জঙ্গি সংগঠনগুলোও টাকার ভাগ পায়।
ইউক্রেনিয়ান একটি জাহাজকে জলদস্যুরা যখন দখল
করে নেয়, তখন শিপিং কোম্পানী খুব দ্রুতই মুক্তিপণ
হিসাবে তিন মিলিয়ন ডলার দিতে রাজী হয়ে যায়।
কিন্তু, তারপরও কয়েক সপ্তাহ লেগে যায় জাহাজটির
মুক্তি পেতে। এর অন্যতম কারণ ছিল যে, এই মুক্তিপণের
টাকার ভাগ নেবার জন্য অসংখ্য লোক যুক্ত ছিল। এর
মধ্যে যেমন ছিল জলদস্যুদের নেতারা, তেমনি ছিল
যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সোমালিয়ান সরকারের লোকজন
এবং তাদের শত্রু ইসলামী জঙ্গী সংগঠন আল-শাবাব।
জলদস্যুদের মুক্তিপণের টাকার ভাগ শাবাব পায়
সে ব্যাপারে অনেকেই দৃঢ় মত পোষণ করে থাকে।
মুক্তিপণের অর্থে দ্রুত ঝলমলে হয়ে উঠছে সোমালিয়ার
সমুদ্রপাড়ের জেলে বসতিগুলো। জলদস্যুদের
অর্থায়নে সেখানে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ঘটছে ব্যবসা-
বাণিজ্যের প্রসার। গড়ে উঠছে বিলাসবহুল হোটেল। আর
এই
জলদস্যুরা সেখানে রাতারাতি সেলিব্রেটি হয়ে উঠছে।
দেশটির অন্যান্য অংশ থেকেও
বিনিয়োগকারীরা সেখানে অর্থ খাটাচ্ছে।
জলদস্যুদের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি আইল থেকে দস্যুদলের সদস্য
বশির আবদুল্লে টেলিফোনে রয়টার্সকে বলেন,
“এখানে এমন অনেক জলদস্যু আছে যারা কখনওই বন্দুক
নিয়ে সমুদ্রে যায়নি। কিন্তু দস্যুবৃত্তির
কাজে লাগানোর জন্য নৌকাসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু
কাজে লাগিয়ে তারা কাড়িকাড়ি অর্থ বানাচ্ছে।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জলদস্যুতা এখন সোমালিয়ার
অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।
জলদস্যু দমন অভিযান :
জলদস্যুদের অত্যাচারে এক রকম অতিষ্ট হয়েই
জাতিসংঘের
নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে আন্তর্জাতিক
নৌবাহিনীর জলদস্যুদের সোমালিয়ান নৌ সীমানায়
ধাওয়া করা এবং জলদস্যুদের
জাহাজগুলোকে ডুবিয়ে দেয়ার আইন পাশ করা হয়।
তবে জলদস্যুরা শুধু সোমালিয়া থেকেই তাদের কার্যক্রম
চালায় না। ইয়েমেনেও তাদের ঘাঁটি রয়েছে। এই দুই
দেশের জলদস্যুদের আবার সখ্যতা রয়েছে আফ্রিকার
হাতি ও গণ্ডারের দাঁত এবং হীরার
চোরাকারাবারিদের সাথে।
সাম্প্রতিককালে সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুদের
উৎপাত ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের
নেতৃত্বে আফ্রিকার সাগর এলাকায় নিবিড় টহল কার্যক্রম
শুরু হয়েছে। অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম সজ্জিত জলদস্যু
মোকাবেলায় হেলিকপ্টারসজ্জিত আন্তর্জাতিক
জাহাজ এখন টহল দিচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে।
তবে এখন পর্যন্ত বিদেশী নৌবাহিনীর সাফল্য
হাতে গোনা। গত বছর জলদস্যুরা দখল করে নিয়েছিল
ফ্রেঞ্চ ইয়ট লা পোনান্ট, তিরিশ জন ক্রুসহ। ফ্রান্সের
প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি জিবুতি ভিত্তিক
ফরাসী কমান্ডোদেরকে একশনে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
দুই মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দেওয়া হয়।
জলদস্যুরা ইয়টকে মুক্ত করে দিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এর
একটা গ্রুপ সোমালিয়ান ডেজার্ট দিয়ে পালাচ্ছিল
জিপে করে। ফরাসী সামরিক হেলিকপ্টার
সেটাকে আক্রমণ
করে এবং জলদস্যুদেরকে আটকে ফ্রান্সে পাঠায়
বিচারের জন্য।
গত বছর নভেম্বরে গালফ অব এডেনে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ
আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয় জলদস্যুদের
একটি মাদারশিপকে।
এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ বাহিনীর জাহাজ
ইউএসএস-এ হামলা চালানোর জন্য পাঁচ সোমালীয়
জলদস্যুকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদেরকে যাবজ্জীবন
কারাদণ্ড দেয়া হতে পারে।
২০০৮ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী এসব
জলদস্যুদের মোকাবিলায় ‘অপারেশন আটলান্টা’ শুরু করে,
তা এখনো চলছে। পরবর্তিতে জার্মান ও ফ্যান্সের যুদ্ধ
জাহাজও এই অপারেশনে যোগ দেয়। কয়েকদিন
আগে তারা বিশ্ব খাদ্য কমসূচির
৯০টি ত্রাণবাহী জাহাজ
গন্তব্যস্থলে নিরাপদে পৌঁছে দেয়।
এর আগে মার্চ ২০০৪ সালে রাশিয়া, চীন ও ভারত
জলদস্যুদের দমনের জন্য ‘সম্মিলিত যৌথ বাহিনী’ গঠন করে।
এডেন সাগরে এই যৌথ
বাহিনী পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে পাহারা দিয়ে
নিরাপদ আশ্রয়ে পৌছে দেয়া ও জলদস্যুদের
জাহাজে আক্রমণের কাজ করছে।
এই দুইটি বাহিনী একসাথে জলদস্যুদের দমনের জন্য কাজ
চালাচ্ছে। পাকিস্তানও জানিয়েছে তারা তাদের
নৌ বাহিনী দিয়ে ওই দুই যৌথ
বাহিনীকে সহায়তা করবে।
২০০৮ সালে চীনের একটি পণ্যবাহী জাহাজ ছিনতায়
হলে, সেটি উদ্ধারের জন্য তাদের দুইটি যুদ্ধজাহাজ
এডেন সাগরে পৌছায়। তারা জলদস্যুদের
বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে এবং জলদস্যুদের বেশ
কয়েকটি বোট ডুবিয়ে দেয়।
২০০৯ সনালে নরওয়ের নৌবাহিনীও জলদস্যুদের
বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। তাদের আক্রমণেও বেশ
কয়েকটি বোট ডুবে যায়।
মার্চ ২০১০ সালে জলদস্যুরা একটি মার্কিন জাহাজ
ছিনতায় করে ২৭জন নাবিককে জিম্মি করে। তাদের
উদ্ধারের জন্য মার্কিন নৌবাহিনী অভিযান চালায়
এবং দুইটি বোট ডুবিয়ে দেয়।
এছাড়াও ২০০৯ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বৃটেন, সুইডেন,
স্পেন, থায়ল্যাণ্ড, কোরিয়া, জাপান, ইতালি,
বুলগেরিয়া, কানাডাসহ প্রায় অর্ধশতটি দেশ
২৭টি অভিযান পরিচালনা করে। যার মধ্য ২০১০সালেই
পরিচালিত হয়েছে ২০টি অভিযান।
ন্যাটো ও সমুদ্রোপকূলীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী চলতি বছর জলদস্যুদের
১২০টি হামলা ঠেকিয়েছে। ২০০৯ সালে ঠেকায় ২১টি।
ইউরোপীয় বাহিনীর হাতে চলতি বছর ৪০০ জন জলদস্যু আটক
হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১৫ জনের বিচার হয়েছে।
এরপরেও ভারত মহাসাগরে বেশ কয়েকটি বাণিজ্য রুট
জলদস্যুদের হুমকির মুখে রয়েছে।
জলদস্যুরাও নতুন কৌশলে
গত তিন বছরে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে এতগুলো অভিযান
এবং বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীসমূহের
টহলদারিরি কারণে যে সাফল্য জমা হয়েছিল
সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহে তা ম্লান হয়ে যাওয়ার পথে।
কোনঠাসা জলদস্যুরা এবার নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। যুদ্ধ
জাহাজগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তাদের
অপারেশনের
ক্ষেত্রকে সরিয়ে নিয়ে গেছে আরো দক্ষিণে।
তারা হয়ে উঠেছে আগের চেয়েও অনেক
বেশি আক্রমণাত্মক এবং মরিয়া। ইন্টারন্যাশনাল
শিপিং এসোসিয়েশন বিমকো বলছে যে, এই আক্রমণ এখন
আর শুধু গালফ অব এডেনেই সীমাবদ্ধ নেই। ভারত
মহাসাগরের বিস্তির্ণ অঞ্চলে এখন
ছড়িয়ে পড়েছে জলদস্যুতা।
যেখানে নাবিকরা জানতো যে আটকা পড়লেও
জানে বেঁচে যাবে তারা মুক্তিপণ আসলেই। এখন আর
সেই নিশ্চয়তা নেই। যেহেতু জলদস্যুরা এখন প্রতিনিয়ত যুদ্ধ
জাহাজের মুখোমুখি হচ্ছে, কখনো বন্দী হচ্ছে,
কখনো বা নিহত হচ্ছে, সেহেতু তারাও এখন আগের
চেয়ে জোর খাটাচ্ছে বেশি, বেশি ভায়োলেন্ট
হচ্ছে। ফলে, তাদের জিম্মিদেরকে আরো বিপন্ন
করে তুলছে তারা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেপুটি অপারেশন কমান্ডার টমাস
আর্নস্ট বলেন, ‘সোমালিয়ার জলদস্যুদের তৎপরতা প্রসার ও
প্রভাব উভয় দিক থেকেই পুষ্ট হয়েছে। দস্যুরা তাদের
সামর্থ্য বাড়িয়েছে। বিশাল এলাকাজুড়ে তাদের
প্রভাব রয়েছে।’
সাম্প্রদিক দিনগুলোতে জলদস্যুরা তানজানিয়া ও
মাদাগাস্কারেও হামলা চালিয়েছে। সেখানে আরও
বড় জাহাজ ছিনতাই করে, বিশাল অঙ্কের মুক্তিপণ আদায়
করে। ভারত মহাসাগর ও আফ্রিকার বিস্তৃর্ণ উপকূল
জুড়ে এখন তারা ছড়িয়ে পড়েছে। সোমালিয়ার
অববাহিকা ও অ্যাডেন উপসাগরে বিদেশি সামরিক
বাহিনীর উপস্থিতি জলদস্যুদের আরও
বেপরোয়া করে তোলে।
সমাধান জলে নয় স্থলে :
সোমালিয়ার উপকূলের গালফ অব এডেন এবং ভারত
মহাসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় যে জলদস্যুতা শুরু
হয়েছে তার সমাধান জলে হবে না। স্থলেই
করতে হবে এর সমাধান। শুধুমাত্র নৌবাহিনীর গুটি কয়েক
যুদ্ধজাহাজ দিয়ে এই বিশাল এলাকাকে নিরাপদ
করা কোনভাবেই সম্ভবপর নয়। স্বল্প সময়ের জন্য হয়তো সম্ভব,
কিন্তু দীর্ঘকালের জন্য সম্ভব নয়। জলদস্যুতার মূল
যেখানে সেখানে গিয়েই সমস্যার সমাধান করাটাই
হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। সোমালিয়ার
ভিতরে শক্তিশালী সরকারের
অভাবে যে অরাজকতা চলছে গত দেড় যুগ ধরে তা দূর
করতে হবে অবিলম্বেই। এজন্য প্রথমেই যেটা দরকার
তা হলো একটি শক্তিশালী সরকার এবং তার
অধীনে সেনাবাহিনী গড়ে তোলা। যুদ্ধবাজ নেতা ও
জঙ্গি দমন করা। বিদ্রোহ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান
করা। সর্বপরি চলমান দুভিক্ষ মোকাবেলা করা। দেশের
ভেতরে কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করা। দেশের
ভিতরে স্থিতিশীলতা আসলেই জলদস্যুদের নিরাপদ আশ্রয়
আর থাকবে না।
জিহাদি জঙ্গিরাও যাতে সোমালিয়ার
সীমানা ছাড়িয়ে আশে পাশের
দেশে ছড়াতে না পারে সেদিকেও লক্ষ্য
রাখা প্রয়োজন। যেহেতু যুদ্ধবাজ নেতা এবং ইসলামিক
মৌলবাদীদের পরাজিত করার মত শক্তিশালী কোন
সশস্ত্র বাহিনী নেই সোমালিয়ায়, কাজে এর জন্য
সবচেয়ে জরুরী কাজ হচ্ছে দেশের
রাজনীতিকে পুনর্বিন্যাস করা এবং তেমন উগ্র নয় সেই সব
মৌলবাদী সংগঠনগুলোর সাথে চুক্তিতে আসা।
কাজটা খুব কঠিন সন্দেহ নেই কিন্তু অসম্ভব নয়।
তা না হলে জলের এই সমস্যা কোনদিনই মিটবে না।
তা সে যতই দাপাদাপি করা হোক না কেন উত্তাল নীল
জলে।
সোমালিয়ায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক বন্ধ হোক
জলদস্যুতা এটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
থেকে দেশটির কেন্দ্রে কোন শক্তিশালি সরকার
আসেনি৷ জুন ২০০৪ সালে দেশটিতে অন্তবর্তিকালীন
কোয়ালিশন সরকার গঠিক হয়। পাঁচ বছরের
মেয়াদে তাদের লক্ষ্য ছিল একটি অন্তর্বতিকালীন
সংবিধান রচনা করা। ২০০৮ সালে তারা একটি নতুন
খসড়া সংবিধান প্রনয়ন করে কিন্তু সেটা নিয়েও
প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।
সেই বিরোধের জের ধরে প্রধানমন্ত্রী ওমর আব্দুর রশিদ
আলী শারমার্ক পদত্যাগ করেন।
গৃহযুদ্ধের কারনে ভেঙে পড়ে দেশটির অর্থনীতি।
কৃষি শিল্পসহ সমগ্র ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হয়।
এমতবস্থায় নতুন দুর্যোগ হিসেবে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। দেশটির
কয়েক কোটি মানুষ ভয়াবহ দুভিক্ষে আক্রান্ত হয়। লক্ষ লক্ষ
মানুষ খাবারের আশায় আর বাচাঁর জন্য
পাশ্ববর্তি দেশে উদ্বাস্তু হয়ে পালিয়ে যেতে থাকে।
একদিকে দুভিক্ষ আর অন্যদিকে গৃহযুদ্ধের
কারনে দেশটি এক রকম নরকে পরিনত হয়। ব্যার্থ
রাষ্ট্রে পরিনত হয় সোমালিয়া।
রহস্যময় জাহাজের আনাগোনা :
এমনই জগাখিচুড়ি যখন সোমালিয়ার অভ্যান্তরিণ
পরিস্থিতি তখন সেই সুযোগে দেশটির
উপকূলে আনাগোনা শুরু হয় রহস্যময় ইউরোপীয় জাহাজের।
তারা চুরি করে সোমালিয়ার উপকূলে প্রবেশ করে,
এবং তড়িঘড়ি করে সাগরে বিরাট বিরাট ব্যারেল
ফেলেই পালিয়ে যায়। তাত্ক্ষণিকভাবে উপকূলের
অধিবাসীরা বুঝতে পারে না সেগুলোতে কি আছে।
বোঝাগেল তখনই যখন তারা অসুস্থ হতে শুরু করলো।
প্রথমে তাদের গায়ে অদ্ভুত সব দাগ দেখা দিতে শুরু করে,
তারপর শুরু হলো বমি। সবচেয়ে মারাত্তক বিষয়
হলো নারীরা বিকলাঙ্গ শিশু প্রসব করতে থাকলো।
বোঝা গেল তেজষ্ক্রিয়তার কারনে এসব হচ্ছে।
রোগাক্রান্ত হয়ে শত শত মানুষ মারা যেতে থাকলো।
২০০৫ সালের পর, সোমালিয়ার উপকূল ভরে যায় হাজার
হাজার পরিত্যক্ত ও ফুটো ব্যারেল। পানি বিষাক্ত
হওয়ার কারনে মরে যেতে থাকলো মাছ। সোমালিয়ায়
জাতিসংঘ প্রতিনিধি আহমেদু আবদাল্লাহ বলেন, ‘কেউ
আমাদের উপকূলে পারমানবিক বর্জ ফেলছে। আরও
ফেলছে সীসা, ক্যামিয়াম ও মার্কারি। নেই
সাথে বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান।’ প্রায় ১০ মিলিয়ন
টন বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য তাদের উপকূলে ফেলা হয়।
তদন্ত করে দেখা গেল এসব আসছে ইউরোপের হাসপাতাল,
কারখানা আর পারমানবিক চুল্লি থেকে।
এমনকি তারা বর্জ ফেলার জন্য মাফিয়াদেরও
ভাড়া করে। ইউরোপীয় সরকারগুলো এবিষয়ে নিশ্চুপ।
তারা এসব বর্জ ফেলা প্রতিরোধ করছে না, বিরতও
থাকছে না, দিচ্ছে না কোন ক্ষতিপূরণ।
একই সময়ে অন্য কিছু ইউরোপীয় দেশগুলোর জাহাজ
সোমালিয়ার সমুদ্র লুটপাট শুরু করে। সোমালিয়ার প্রধান
সম্পদ তাদের সামুদ্রিক মাছের ভাণ্ডার। সোমালিয়ার
সমূদ্র উপকূল থেকে তারা প্রতিবছর ৩০০ মিলিয়ন ডলারের
টুনা, চিংড়ি, গলদা চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ
ধরে নিয়ে যায়।
শুরু হলো প্রতিরোধ :
সমূদ্রে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ
করে যে জেলে সম্প্রদায় তারা বুঝতে পারলো এবার
তাদের সর্বস্ব খোয়া যেতে বসেছে। মোহাম্মদ হোসেন
নামে এক যুবক বলে, ‘যদি কিছুই করা না হয়, অল্পদিনের
মধ্যেই আমাদের সমুদ্র মাছহীন
হয়ে পড়বে।’তারা ভাবলো বিছু একটা করা দরকার। তখন
তারা প্রথমে স্পিডবোট নিয়ে বর্জ্র্য ফেলা ও মাছ ধরার
জাহাজ আর ট্রলারগুলিকে তাড়িয়ে দেওয়ার
চেষ্টা করে। এভাবেও যখন পারা গেল না তখন
একপর্যায়ে তাদের ওপর ‘ট্যাক্স’ বসানোরও
চেষ্টা করে জেলেরা। কিন্তু তাতেও তাদের
ঠেকানো গেল না। এক পর্যায়ে একরকম বাধ্য হয়েই
তারা হাতে তুলে নিল অস্ত্র। মাছ চুরি করা আর বর্জ
ফেলা জাহাজগুলোকে তারা দখল করে নিতে শরু করলা।
তারা বুঝতে পারলো জাহাজগুলি দখল করা যায়। এই
সাধাসিধা জেলেরা এবার হয়ে উঠলো ‘জলদস্যু’।
তাদের এক নেতা সুগুল আলি বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য
হলো বেআইনী মাছ ধরা এবং উপকূল পারমানবিক ও
রাসায়নিক বর্জ ফেলা বন্ধ করা।…আমরা জলদস্যু নই…ওরাই
জলদস্যু যারা আমাদের মাছ কেড়ে নেয়, যারা আমাদের
সমুদ্র বিষ দিয়ে ভরে ফেলে এবং আমাদের
পানিতে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করে।’
স্থানীয়দের কাছে এই ‘জলদস্যু’রা বিপুলভাবে জনপ্রিয়।
সোমালিয়ার একটি সংবাদ সংস্থার
জরিপে উঠে আসে বিস্ময়কর তথ্য। ৭০ ভাগ সোমালিয়
মনে করে ‘জলদস্যুতাই এখন তাদের সমুদ্র প্রতিরক্ষার
জাতীয় কৌশল।
দস্যু বৃত্তির সূচনা :
বর্জ ফেলা জাহাজ আটকের মধ্য দিয়ে তাদের
আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেল। তাদের মধ্য সুযোগ
সন্ধানী একটি অংশ কৌশল পরিবর্তন করলো। জাহাজ ও
নাবিকদের আটক করে মুক্তিপণ আদায় জলদস্যুদের বড়
কৌশল হয়ে দাঁড়ালো। এবার
তারা হয়ে উঠলো সত্যিকারের জলদস্যু। এর মধ্যে অনেক
জাহাজ আটক করে নাবিকদের জিম্মি করা হয়েছে।
সোমালিয়ার সরকার গোটা দেশের নিয়ন্ত্রণ
নিতে ইসলামী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
জলদস্যুতা রোধে তারা খুবই অসহায়। গৃহযুদ্ধ আর
জঙ্গি দমনে সরকার এত বেশি ব্যাস্ত আর বিপর্যস্ত
যে জলদস্যু দমন তাদের সামর্থের বাইরে।
সেই সুযোগে সোমালিয়ার বিশাল উপকূলীয়
এলাকা জলদস্যুদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হলো।
তারা এতটাই দুধর্ষ জলদস্যুতে পরিণত হলো যে, দুনিয়ার বড়
বড় শিপিং কোম্পানিগুলো আর সরকারের ঘুম হারাম
করে দিতে থাকলো। বিশেষ
করে যারা ব্যাবসা বানিজ্যের জন্য আরব সাগর আর
লোহীত সাগর ব্যাবহার করে তাদের জন্য। এই
রুটটি হয়ে উঠলো পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদসঙ্কুল জলপথ।
সমুদ্র নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন,
সোমালিয়ায় মাত্র পাঁচটি জলদস্যু দল এবং তাদের
অধীনে ১২ শ’র বেশি বন্দুকধারী জলদস্যু আছে।
তারা লোহিত সাগরের দক্ষিণাংশে চলাচল
করা বিদেশী জাহাজকে ধরতে সমুদ্রে মাছ ধরা নৌযান
ব্যবহার করে। মাছ ধরা ট্রলারের
ছদ্ববেশে তারা সাগরে অবস্থান করে আর সুযোগ
বুঝে বানিজ্যিক হাজাজে হামলা করে। রাতের
বেলা বড় বড় জাহাজগুলোকে বেপরোয়াভাবে আক্রমণ
করে তারা। হেভি মেশিনগান এবং রকেট প্রপেলড
গ্রেনেড দিয়ে সূত্রপাত হয় সেই সব আক্রমণের।
এ কাজে তারা অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার
করে। ব্যবহার করে রকেটচালিত গ্রেনেড। এছাড়াও
তারা ব্যবহার করছে মোবাইল ফোন, স্যাটেলাইট ফোন,
জিপিএস, সোলার সিস্টেম, আধুনিক স্পিডবোট, অ্যাসল্ট
রাইফেল, শটগান, গ্রেনেড লঞ্চারসহ অত্যাধুনিক সরঞ্জাম।
গভীর সাগরে মাদারশিপ এবং সেখান
থেকে পরিচালিত স্পিডবোট, ভারী যন্ত্রপাতি,
স্যাটেলাইট ইকুইপমেন্ট, এবং মুক্তিপণের জন্য
বিদেশে মধ্যস্থতাকারী নিয়ে কারবার এখন তাদের।
আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) হিসাবমতে,
২০০৬ সালে জলদস্যুদের ২৩৯টি হামলার ঘটনায় ৭৭ নাবিক
অপহৃত হয়েছেন, জিম্মি করা হয়েছে ১৮৮ জনকে। নিহত
হয়েছেন ১৫ জন। ২০০৭ সালে জলদস্যু হামলা ১০ শতাংশ
বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬৩-তে। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ
হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। ২০০৯ সালের
প্রথম ৯ মাসে ছিল আগের বছরের চেয়েও বেশি। এ সময়
সবচেয়ে বেশি হামলা হয়েছে এডেন সাগর ও
সোমালিয়া উপকূলে। ২০০৫ সালের
নভেম্বরে সোমালিয়া উপকূলে আক্রান্ত হয়
একটি মার্কিন ক্রুজ শিপ।
জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী গত বছর গালফ অব
এডেনের করিডোরে ১১১টি আক্রমণ হয়েছে, যা আগের
বছরের তুলনায় ২০০ গুণ বেশি। ইন্টারন্যাশনাল ম্যারিটাইম
ব্যুরো জানাচ্ছে যে, বিশটারও বেশি দেশের
নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজের উপস্থিতি সত্ত্বেও গালফ
অব এডেনে গত বছরে আক্রমণের
সংখ্যা হচ্ছে ৫১টি জাহাজ। প্রায় এক হাজার নাবিক
তারা জিম্মি করে রেখেছে।
জলদস্যুদের এড়িয়ে বানিজ্য
জাহাজগুলি পরিচালনা করা এক কথায় অসম্ভব। কারন
এশিয়ার দেশগুলো উইরোপের সাথে বানিজ্য
করতে চাইলে ভারত ও আরব উপসাগর দিয়ে সুয়েজ খাল
অতিক্রম করেই কেবল ভূমধ্য সাগরে পৌছানো সম্ভব। আর এই
পথে জাহাজগুলিকে সোমালিয়ার উপকূল অতিক্রম
করতেই হবে। আর একটি পথ আছে ইউরোপ থেকে পূর্ব ও
দক্ষিণ এশিয়ায় পৌছানোর ভস্কো দা গামার আবিস্কৃত
উত্তামাশা অন্তরিপ। কিন্তু এতো পথ ঘুরে বানিজ্য
করতে গেলে ব্যাবসায়ে লালবাতি জ্বলার সম্ভাবনাই
বেশি।
আর এ কারনেই জলদস্যুদের এড়ানোটা প্রচণ্ড রকমের ব্যয়বহুল
হয়ে পড়েছে শিপিং কোম্পানীগুলোর জন্য।
মোম্বাসা বন্দরের হারবার মাস্টার তালিব খামিস
বলেন যে, জলদস্যুদের এড়ানোর জন্য গালফ অব এডেন
থেকে মোম্বাসা যাওয়ার জন্য সব জাহাজকেই
অতিরিক্ত দুই দিন সময় নিতে হচ্ছে ঘুরপথে আসার জন্য।
এছাড়া এই এলাকায় চলাচলকারী জাহাজের
ইনশিওরেন্সের প্রিমিয়ামও হয়ে উঠেছে অনেক উচ্চ।
কাজেই জাতিসংঘের সশস্ত্র পাহারা ছাড়া কোন
শিপিং কর্পোরেশনকে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে তাদের
বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে জাহাজ ভাড়া দেওয়ার জন্য
রাজি করানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
তবে এই জলদস্যু সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ
হচ্ছে সোমালিয়া নিজেই। সোমালিয়ার আট মিলিয়ন
লোকের মধ্যে আড়াই মিলিয়ন লোকই সাগর
দিয়ে আসা খাদ্যের উপর নির্ভরশীল।
মোম্বাসা থেকে মোগাদিসু পর্যন্ত জাতিসংঘের
ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের
খাদ্যবাহী জাহাজগুলোকে ফরাসী, ডেনিশ এবং ডাচ
যুদ্ধজাহাজগুলো এসকোর্ট দিচ্ছে অনেকদিন ধরেই। কিন্তু
তা সত্ত্বেও এই সাপ্লাই লাইন সবসময়ই বিপদজনক এবং ভঙ্গুর
রয়ে গেছে। গত বছরের মে মাসে সোমালিয়ার জন্য
চিনি বয়ে নিয়ে যাওয়া জর্ডানিয়ান জাহাজ
ভিক্টোরিয়াকে মোগাদিসুর ৩৫ মাইল দূর
থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। একসপ্তাহ
পরে ছাড়া পায় সেই জাহাজ।
‘জলদস্যু’ বানিজ্য :
সেমালিয়াতে জলদস্যুতা এখন বিশাল
বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। দুবাই এবং অন্যান্য
দেশে থাকা সোমালিরা বিনিয়োগ করছে এই ব্যবসায়
বিপুল পরিমাণে। সোমালি জলদস্যুদের লুট করা টাকায়
বন্দর ঈলে বিশাল বিশাল ভিলা এবং হোটেল
তৈরি হয়ে গেছে। এক সময়কার গরীব জেলেরা এখন
মার্সিডিজ বেঞ্জ হাকাচ্ছে। শুধুমাত্র ২০০৮ সালেই
সোমালিয়ান জলদস্যুরা আয় করেছে একশ পঁচিশ মিলিয়ন
ডলার। বিশাল মুনাফার কারণে সোমালিয়ার অনেক
যুদ্ধবাজ গোত্র নেতারাই সুসংগঠিত উপায়ে শুরু
করেছে জলদস্যু ব্যবসা। দলে দলে দরিদ্র
জেলে ছেলেরা জলদস্যু দলে নাম লেখানোর জন্য
উঠে পড়ে লেগেছে। এই ব্যবসার আসল
লোকজনেরা রয়েছে পর্দার অন্তরালে। অন্যসব ব্যবসার মতই
সম্মুখসারির জলদস্যুদের হাতে টাকার খুব সামান্য অংশই
যায়। বেশিরভাগ অংশটাই চলে যায় নেপথ্যের
হোমড়া চোমড়াদের কাছে।
অভিযোগ রয়েছে সোমালিয়ার সেনাবাহিনী,
কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রি ও নেতারা এমন কি ইউরোপ
আমেরিকার অনেক বড় বড় ব্যাবসায়ি এই লুটের টাকার
ভাগ পেয় থাকে। এছাড়াও যুদ্ধবাজ গোষ্ঠি নেতারা ও
জঙ্গি সংগঠনগুলোও টাকার ভাগ পায়।
ইউক্রেনিয়ান একটি জাহাজকে জলদস্যুরা যখন দখল
করে নেয়, তখন শিপিং কোম্পানী খুব দ্রুতই মুক্তিপণ
হিসাবে তিন মিলিয়ন ডলার দিতে রাজী হয়ে যায়।
কিন্তু, তারপরও কয়েক সপ্তাহ লেগে যায় জাহাজটির
মুক্তি পেতে। এর অন্যতম কারণ ছিল যে, এই মুক্তিপণের
টাকার ভাগ নেবার জন্য অসংখ্য লোক যুক্ত ছিল। এর
মধ্যে যেমন ছিল জলদস্যুদের নেতারা, তেমনি ছিল
যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সোমালিয়ান সরকারের লোকজন
এবং তাদের শত্রু ইসলামী জঙ্গী সংগঠন আল-শাবাব।
জলদস্যুদের মুক্তিপণের টাকার ভাগ শাবাব পায়
সে ব্যাপারে অনেকেই দৃঢ় মত পোষণ করে থাকে।
মুক্তিপণের অর্থে দ্রুত ঝলমলে হয়ে উঠছে সোমালিয়ার
সমুদ্রপাড়ের জেলে বসতিগুলো। জলদস্যুদের
অর্থায়নে সেখানে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ঘটছে ব্যবসা-
বাণিজ্যের প্রসার। গড়ে উঠছে বিলাসবহুল হোটেল। আর
এই
জলদস্যুরা সেখানে রাতারাতি সেলিব্রেটি হয়ে উঠছে।
দেশটির অন্যান্য অংশ থেকেও
বিনিয়োগকারীরা সেখানে অর্থ খাটাচ্ছে।
জলদস্যুদের অন্যতম শক্ত ঘাঁটি আইল থেকে দস্যুদলের সদস্য
বশির আবদুল্লে টেলিফোনে রয়টার্সকে বলেন,
“এখানে এমন অনেক জলদস্যু আছে যারা কখনওই বন্দুক
নিয়ে সমুদ্রে যায়নি। কিন্তু দস্যুবৃত্তির
কাজে লাগানোর জন্য নৌকাসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু
কাজে লাগিয়ে তারা কাড়িকাড়ি অর্থ বানাচ্ছে।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জলদস্যুতা এখন সোমালিয়ার
অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।
জলদস্যু দমন অভিযান :
জলদস্যুদের অত্যাচারে এক রকম অতিষ্ট হয়েই
জাতিসংঘের
নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে আন্তর্জাতিক
নৌবাহিনীর জলদস্যুদের সোমালিয়ান নৌ সীমানায়
ধাওয়া করা এবং জলদস্যুদের
জাহাজগুলোকে ডুবিয়ে দেয়ার আইন পাশ করা হয়।
তবে জলদস্যুরা শুধু সোমালিয়া থেকেই তাদের কার্যক্রম
চালায় না। ইয়েমেনেও তাদের ঘাঁটি রয়েছে। এই দুই
দেশের জলদস্যুদের আবার সখ্যতা রয়েছে আফ্রিকার
হাতি ও গণ্ডারের দাঁত এবং হীরার
চোরাকারাবারিদের সাথে।
সাম্প্রতিককালে সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যুদের
উৎপাত ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের
নেতৃত্বে আফ্রিকার সাগর এলাকায় নিবিড় টহল কার্যক্রম
শুরু হয়েছে। অত্যাধুনিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম সজ্জিত জলদস্যু
মোকাবেলায় হেলিকপ্টারসজ্জিত আন্তর্জাতিক
জাহাজ এখন টহল দিচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে।
তবে এখন পর্যন্ত বিদেশী নৌবাহিনীর সাফল্য
হাতে গোনা। গত বছর জলদস্যুরা দখল করে নিয়েছিল
ফ্রেঞ্চ ইয়ট লা পোনান্ট, তিরিশ জন ক্রুসহ। ফ্রান্সের
প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি জিবুতি ভিত্তিক
ফরাসী কমান্ডোদেরকে একশনে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
দুই মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দেওয়া হয়।
জলদস্যুরা ইয়টকে মুক্ত করে দিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এর
একটা গ্রুপ সোমালিয়ান ডেজার্ট দিয়ে পালাচ্ছিল
জিপে করে। ফরাসী সামরিক হেলিকপ্টার
সেটাকে আক্রমণ
করে এবং জলদস্যুদেরকে আটকে ফ্রান্সে পাঠায়
বিচারের জন্য।
গত বছর নভেম্বরে গালফ অব এডেনে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ
আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয় জলদস্যুদের
একটি মাদারশিপকে।
এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ বাহিনীর জাহাজ
ইউএসএস-এ হামলা চালানোর জন্য পাঁচ সোমালীয়
জলদস্যুকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদেরকে যাবজ্জীবন
কারাদণ্ড দেয়া হতে পারে।
২০০৮ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী এসব
জলদস্যুদের মোকাবিলায় ‘অপারেশন আটলান্টা’ শুরু করে,
তা এখনো চলছে। পরবর্তিতে জার্মান ও ফ্যান্সের যুদ্ধ
জাহাজও এই অপারেশনে যোগ দেয়। কয়েকদিন
আগে তারা বিশ্ব খাদ্য কমসূচির
৯০টি ত্রাণবাহী জাহাজ
গন্তব্যস্থলে নিরাপদে পৌঁছে দেয়।
এর আগে মার্চ ২০০৪ সালে রাশিয়া, চীন ও ভারত
জলদস্যুদের দমনের জন্য ‘সম্মিলিত যৌথ বাহিনী’ গঠন করে।
এডেন সাগরে এই যৌথ
বাহিনী পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে পাহারা দিয়ে
নিরাপদ আশ্রয়ে পৌছে দেয়া ও জলদস্যুদের
জাহাজে আক্রমণের কাজ করছে।
এই দুইটি বাহিনী একসাথে জলদস্যুদের দমনের জন্য কাজ
চালাচ্ছে। পাকিস্তানও জানিয়েছে তারা তাদের
নৌ বাহিনী দিয়ে ওই দুই যৌথ
বাহিনীকে সহায়তা করবে।
২০০৮ সালে চীনের একটি পণ্যবাহী জাহাজ ছিনতায়
হলে, সেটি উদ্ধারের জন্য তাদের দুইটি যুদ্ধজাহাজ
এডেন সাগরে পৌছায়। তারা জলদস্যুদের
বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে এবং জলদস্যুদের বেশ
কয়েকটি বোট ডুবিয়ে দেয়।
২০০৯ সনালে নরওয়ের নৌবাহিনীও জলদস্যুদের
বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। তাদের আক্রমণেও বেশ
কয়েকটি বোট ডুবে যায়।
মার্চ ২০১০ সালে জলদস্যুরা একটি মার্কিন জাহাজ
ছিনতায় করে ২৭জন নাবিককে জিম্মি করে। তাদের
উদ্ধারের জন্য মার্কিন নৌবাহিনী অভিযান চালায়
এবং দুইটি বোট ডুবিয়ে দেয়।
এছাড়াও ২০০৯ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বৃটেন, সুইডেন,
স্পেন, থায়ল্যাণ্ড, কোরিয়া, জাপান, ইতালি,
বুলগেরিয়া, কানাডাসহ প্রায় অর্ধশতটি দেশ
২৭টি অভিযান পরিচালনা করে। যার মধ্য ২০১০সালেই
পরিচালিত হয়েছে ২০টি অভিযান।
ন্যাটো ও সমুদ্রোপকূলীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী চলতি বছর জলদস্যুদের
১২০টি হামলা ঠেকিয়েছে। ২০০৯ সালে ঠেকায় ২১টি।
ইউরোপীয় বাহিনীর হাতে চলতি বছর ৪০০ জন জলদস্যু আটক
হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১৫ জনের বিচার হয়েছে।
এরপরেও ভারত মহাসাগরে বেশ কয়েকটি বাণিজ্য রুট
জলদস্যুদের হুমকির মুখে রয়েছে।
জলদস্যুরাও নতুন কৌশলে
গত তিন বছরে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে এতগুলো অভিযান
এবং বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনীসমূহের
টহলদারিরি কারণে যে সাফল্য জমা হয়েছিল
সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহে তা ম্লান হয়ে যাওয়ার পথে।
কোনঠাসা জলদস্যুরা এবার নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। যুদ্ধ
জাহাজগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তাদের
অপারেশনের
ক্ষেত্রকে সরিয়ে নিয়ে গেছে আরো দক্ষিণে।
তারা হয়ে উঠেছে আগের চেয়েও অনেক
বেশি আক্রমণাত্মক এবং মরিয়া। ইন্টারন্যাশনাল
শিপিং এসোসিয়েশন বিমকো বলছে যে, এই আক্রমণ এখন
আর শুধু গালফ অব এডেনেই সীমাবদ্ধ নেই। ভারত
মহাসাগরের বিস্তির্ণ অঞ্চলে এখন
ছড়িয়ে পড়েছে জলদস্যুতা।
যেখানে নাবিকরা জানতো যে আটকা পড়লেও
জানে বেঁচে যাবে তারা মুক্তিপণ আসলেই। এখন আর
সেই নিশ্চয়তা নেই। যেহেতু জলদস্যুরা এখন প্রতিনিয়ত যুদ্ধ
জাহাজের মুখোমুখি হচ্ছে, কখনো বন্দী হচ্ছে,
কখনো বা নিহত হচ্ছে, সেহেতু তারাও এখন আগের
চেয়ে জোর খাটাচ্ছে বেশি, বেশি ভায়োলেন্ট
হচ্ছে। ফলে, তাদের জিম্মিদেরকে আরো বিপন্ন
করে তুলছে তারা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেপুটি অপারেশন কমান্ডার টমাস
আর্নস্ট বলেন, ‘সোমালিয়ার জলদস্যুদের তৎপরতা প্রসার ও
প্রভাব উভয় দিক থেকেই পুষ্ট হয়েছে। দস্যুরা তাদের
সামর্থ্য বাড়িয়েছে। বিশাল এলাকাজুড়ে তাদের
প্রভাব রয়েছে।’
সাম্প্রদিক দিনগুলোতে জলদস্যুরা তানজানিয়া ও
মাদাগাস্কারেও হামলা চালিয়েছে। সেখানে আরও
বড় জাহাজ ছিনতাই করে, বিশাল অঙ্কের মুক্তিপণ আদায়
করে। ভারত মহাসাগর ও আফ্রিকার বিস্তৃর্ণ উপকূল
জুড়ে এখন তারা ছড়িয়ে পড়েছে। সোমালিয়ার
অববাহিকা ও অ্যাডেন উপসাগরে বিদেশি সামরিক
বাহিনীর উপস্থিতি জলদস্যুদের আরও
বেপরোয়া করে তোলে।
সমাধান জলে নয় স্থলে :
সোমালিয়ার উপকূলের গালফ অব এডেন এবং ভারত
মহাসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় যে জলদস্যুতা শুরু
হয়েছে তার সমাধান জলে হবে না। স্থলেই
করতে হবে এর সমাধান। শুধুমাত্র নৌবাহিনীর গুটি কয়েক
যুদ্ধজাহাজ দিয়ে এই বিশাল এলাকাকে নিরাপদ
করা কোনভাবেই সম্ভবপর নয়। স্বল্প সময়ের জন্য হয়তো সম্ভব,
কিন্তু দীর্ঘকালের জন্য সম্ভব নয়। জলদস্যুতার মূল
যেখানে সেখানে গিয়েই সমস্যার সমাধান করাটাই
হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। সোমালিয়ার
ভিতরে শক্তিশালী সরকারের
অভাবে যে অরাজকতা চলছে গত দেড় যুগ ধরে তা দূর
করতে হবে অবিলম্বেই। এজন্য প্রথমেই যেটা দরকার
তা হলো একটি শক্তিশালী সরকার এবং তার
অধীনে সেনাবাহিনী গড়ে তোলা। যুদ্ধবাজ নেতা ও
জঙ্গি দমন করা। বিদ্রোহ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান
করা। সর্বপরি চলমান দুভিক্ষ মোকাবেলা করা। দেশের
ভেতরে কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করা। দেশের
ভিতরে স্থিতিশীলতা আসলেই জলদস্যুদের নিরাপদ আশ্রয়
আর থাকবে না।
জিহাদি জঙ্গিরাও যাতে সোমালিয়ার
সীমানা ছাড়িয়ে আশে পাশের
দেশে ছড়াতে না পারে সেদিকেও লক্ষ্য
রাখা প্রয়োজন। যেহেতু যুদ্ধবাজ নেতা এবং ইসলামিক
মৌলবাদীদের পরাজিত করার মত শক্তিশালী কোন
সশস্ত্র বাহিনী নেই সোমালিয়ায়, কাজে এর জন্য
সবচেয়ে জরুরী কাজ হচ্ছে দেশের
রাজনীতিকে পুনর্বিন্যাস করা এবং তেমন উগ্র নয় সেই সব
মৌলবাদী সংগঠনগুলোর সাথে চুক্তিতে আসা।
কাজটা খুব কঠিন সন্দেহ নেই কিন্তু অসম্ভব নয়।
তা না হলে জলের এই সমস্যা কোনদিনই মিটবে না।
তা সে যতই দাপাদাপি করা হোক না কেন উত্তাল নীল
জলে।
সোমালিয়ায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক বন্ধ হোক
জলদস্যুতা এটাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন