আমি তাকে পেলাম না। জানি না কেন, তবু আমি তাকে পেলাম না। জীবন-মন-প্রাণ সবকিছু ঢেলে দিয়ে তাকে আমি ভালোবাসলাম, তবু কোন কাজ হলো না। আমার অনুভূতিগুলো শূণ্য পড়ে রইল আমার বুকের গহীন কোণে। সময় গেলে তাতে মরচে ধরে যাবে, শেওলা জমবে। কিন্তু কারও জন্য আর কোনদিন প্রকাশ পাবে না। ফারিয়াকে আমি এতো করে কেন চেয়েছি আমি তা নিজেও জানি না। আমি গাছের ছায়ায় ঢাকা রাস্তা দিয়ে হেটে যাবার স্বপ্ন দেখতাম, আমি তা পেয়েছি। পাখির ডাক শুনে আর ভোরের রোদ মুখে মেখে ঘুম থেকে উঠতে চাইতাম, শেষ বেলার সূর্য দেখতে দেখতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে চাইতাম। রাতের কনকনে হাওয়ায় ঝি-ঝি পোকার শব্দ শুনতে শুনতে বুনো পথ ধরে হেটে যেতে চাইতাম। চাইতাম শরৎচন্দ্র অথবা মানিক বন্দোপাধ্যায় এর কোন উপন্যাস হাতে নিয়ে গাছতলায় বসে থাকতে। সত্যি কথা বলতে মানুষের চাওয়ার কোন শেষ থাকে না। আমি যা যা চেয়েছি, সবকিছুই বিভিন্ন রূপে আমার সামনে ধরা দিয়েছে, তবুও আমি কেন ফারিয়াকে চাইলাম? আমি সত্যিই জানি না। পৃথিবীতে সব প্রশ্নের উত্তর লেখা সম্ভব হয় না। এসব প্রশ্ন শুধু হারিয়েই যাবে মহাকাল থেকে মহাকালে। ফারিয়াকে হারিয়ে আমি চূড়ান্ত মাত্রার বিমর্ষ হয়ে গেলাম। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করা ছেড়ে দিলাম। সময়ের কোন হিসেব আমার কাছে থাকতো না। বন্ধুরা সবাই পাগল ভাবতে শুরু করল। তারা শুধু জানতো কোন একটা মেয়েকে আমি পছন্দ করি, যে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার ভালোর জন্যই হয়তো, তারা আমার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিল। বাবা-মাকে বলল আমাকে যেন তারা বাসায় রেখেই ক্লাস করায়। আমি কারও কথায় কোনও আপত্তি জানালাম না। শেষ কবে আপত্তি জানিয়েছি তাও আমার মনে পড়ছিল না। জীবন-সংসারের প্রতি বিতৃষ্ণায় আপত্তি জানানোর শক্তিটুকুও আমি যেন হারিয়ে ফেলেছি। মা শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আর ক্ষণিক পর পর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বাবা দূর থেকে দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমার অবস্থা হলো অনেকটা কোমাগ্রস্থ রোগীর মতো। সবকিছু দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু কোনকিছুতে কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। আমার এ অবস্থার কথা শুনে কানাডা থেকে ভাইয়া-ভাবী এলো আমাকে দেখতে। আপুও তার শ্বশুরবাড়ী ফেলে এসে কিছুদিনের জন্য আমাদের বাসার মেহমান হয়ে গেলো। আমার এক খালাতো ভাইকে জোগাড় করে আনা হলো, আমার দুই বছরের ছোট। সবেমাত্র ফার্স্ট ইয়ার এ পড়ে। সে আমার সাথে সাথে ভার্সিটি যেতো। আমাকে চোখে চোখে রাখত। অবশ্য তার দরকার ছিলো না। আমি তো একটা বাহন মাত্র, চালালে চলবে, না হলে পড়ে থাকবে জড় পদার্থের মতো। ভাবী আর আপু সারাক্ষণ আমার পাশে বসে থাকে। একজন খাইয়ে দেয়, তো অন্যজন মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আমি বুঝতে পারি তাদের এ কষ্টের স্বীকৃতিস্বরূপ আমার একটা ধন্যবাদসূচক হাসি দেয়া উচিত। কিন্তু কেন জানি সেটা দেয়ারও শক্তি সঞ্চয় করতে পারি না। বাবা অপেক্ষা করছিলেন তার বন্ধু বিশিষ্ট সাইক্রিয়াটিস্ট আমজাদ হোসেন এর জন্য। তিন কি চারদিন পর তিনি এলেন আমাদের বাসায় আমার সাথে দেখা করতে। আমার এ অবস্থা কেন হয়েছে সে সম্পর্কে বাসার কেউ ই কিছু জানে না। শুধু জানে মেয়েঘটিত কোন ব্যাপার। আমাকে কোন শারিরীক ডাক্তার দেখিয়ে কিছু করা যায় নি, কারণ হ্যা-না-খাব-ঘুমাব জাতীয় কথাবার্তা আমি ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছিলাম। মজা হলো যখন আমজাদ আঙ্কেল কথা বলতে এলেন। -কেমন আছ এখন? -আপনার কি মনে হয়? -দেখে তো মনে হচ্ছে ভালোই আছ ওপর দিয়ে। ভেতরটা বোধহয় ঠিক নেই। -কেন? কি হয়েছে ভেতরে? -সেটা তো তুমিই বলবে আমাকে। সেটা শুনতেই তো এলাম। বলেই তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, কি ব্যাপার? কোন মেয়েকে পছন্দ করেছ? -হুমম। -সে কি বলেছে? -কিছু বলেনি। চলে গিয়েছে। কোন নাম ঠিকানাও রেখে যায় নি। আমার সাথে আর যোগাযোগ করতে চায় না। -আচ্ছা! তো, নাম কি ছিল মেয়েটার? -ফারিয়া। -বাহ্। বেশ সুন্দর নাম তো। দেখতে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর ছিলো? -সেটা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। এখানে একটা কথা বলা দরকারঃ আমজাদ আংকেল বলেছিলেন আমাদের কথাবার্তাটা যেন প্রাইভেট হয়, কিন্তু আমি ভালোভাবেই টের পেলাম বাড়িশুদ্ধ মানুষ আমাদের এ কথোপকথোন শোনার চেষ্টা করছে। -তারমানে অনেক সুন্দর। বেশ বেশ। তা সে তো চলে গেছে, তুমি এমন হয়ে গেলে কেন? -কেমন হয়ে গেছি? -এই যে, কোন কিছুর প্রতি আগ্রহ নেই, ঠিকমতো খাও না, ঘুমাও না… -জাগতিক জিনিসের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। এখন কোন কিছুই করতে আর ভালো লাগে না। তাই করি না। -যে তোমাকে চায় না, তার জন্য তুমি এতো কষ্ট সহ্য করবে? -এতো কঠিন কথা আমি বুঝি না। আমার মন যা চায়, তা করি। যা চায় না, করি না। আমজাদ আঙ্কেল আর বলার কিছু পেলেন না। কিছুক্ষণ বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাকিয়ে চলে গেলেন বাবার সাথে কথা বলতে। আমিও আর করার কিছু না পেয়ে উঠে গেলাম। সবচেয়ে ভালো যে ব্যাপারটা হলো, ফারিয়া চলে যাবার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমার চারপাশের ভালোবাসার মানুষগুলো আমাকে একা থাকতে দেয়নি। রাতে ঘুমোনোর সময় আমার খালাত ভাই আমার পাশের এক বিছানায় আমার ঘরেই ঘুমোয়। সারাদিন মা-আপু-ভাবী সাথে সাথে থাকে। তারপরও আমার একাকীত্ব কাটছিল না। যে সঙ্গের ছোয়া ফারিয়া আমাকে দিয়েছে, যে ভালোলাগার অনুভূতির সাথে সে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, তা আমি অনেক চেষ্টা করেও চারপাশের এই মানুষগুলোর মাঝে খুজে পেলাম না। মানুষের ভাগ্য মানুষের সাথে খুবই হাস্যকর খেলা খেলে সবসময়। শেষ পর্যন্ত আমজাদ আঙ্কেল আমার জন্য ওষুধ দিলেন। এই ওষুধ খেলে নাকি আমি শতকরা ১০০ ভাগ ঠিক হয়ে যাবো। আপু আর ভাবীকে দেখে মনে হলো তারা খুবই খুশি হয়েছে। আপু দুলাভাই কেও ডেকে আনল। আমার দুলাভাই খুবই মজার কিসিমের মানুষ, ভাইয়ার মতো এতো রসকষহীন না। দুলাভাই আসায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমার মন ভালো হয়ে গেল। -ওই শালা, কি খবর? -খারাপ। -কেন? খারাপ কেন? -ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে। ওষুধ খেতে হবে। -তাতে সমস্যা কোথায়? সপ্তাহ দুই এর জন্য বেড়িয়েই আসলে না হয়। এই ওষুধ খাবার জন্য তো আমি একপায়ে খাড়া। -আমার এই মুহূর্তে প্রকৃতি দেখতে ইচ্ছে করছে না দুলাভাই। -তা তোমার কি করতে ইচ্ছে করছে? -ফারিয়ার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। -তো বলবে সমস্যা কি? -কিভাবে বলব? ও তো চলে গেছে। -আরে দুনিয়াতে কি একটাই ফারিয়া আছে নাকি? এই যেমন ধরো, তোমার আপুর নাম সামিয়া, আমাদের অফিসে একটা মেয়ের নামও সামিয়া। একদিন হলো কি… একদিন কি হলো সেই ঘটনা আমার আর শোনা হলো না। কারণ ততোক্ষণে আপু চলে এসেছে এবং এ্যানাকোণ্ডার বিষদৃষ্টি নিয়ে দুলাভাই এর দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের খণ্ডকালীন ঝগড়া কি হলো আমার ঠিক খেয়াল হলো না। আমার মাথায় তখন শুধু একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে: দুনিয়াতে কি একটাই ফারিয়া আছে নাকি? কোথায় বেড়াতে যাওয়া হবে সেটা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হলো। কেউ বলে রাঙামাটি যাওয়া হোক, কেউ বলে সিলেট। কেউ আবার কক্সবাজারের কথাও তুলল। কক্সবাজার যে কোনদিনই যাওয়া হবে না সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। আপু পানি এতটাই ভয় পায়, পানি খেতে গেলেও চোখ বন্ধ করে খায়। শেষমেষ যখন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হলো না, তখন বাবা বললেন আমার সিদ্ধান্ত যা হবে সেটাই চূড়ান্ত। আমার কোন মতামত দেয়ার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু সবার উৎসাহে পানি ঢালতে চাইলাম না। আমার শুধু মনে পড়ে অনেক ছোটবেলায় মা একবার চট্টগ্রাম যেতে চেয়েছিলো। সেখানের পাহাড়গুলো নাকি অনেক সুন্দর, মেঘের সাথে মিশে যায়। আমি তাই মুখ দিয়ে একটা শব্দই উচ্চারণ করলাম, চট্টগ্রাম। হঠাৎ মনে হলো সবাই যেন একটু ভিরমি খেলো। আমার মাঝে অপরাধবোধ কাজ করা শুরু করবে ঠিক তখনই সবাই জোরে জোরে হেসে উঠলো। যাওয়ার জায়গাটা একটা উসিলা মাত্র, বেড়াতে যাওয়াটাই আসল। তবে কেউ খেয়াল করলো কি না জানি না, আমি আড়চোখে ঠিকই দেখতে পেলাম মায়ের চোখে জল। একটু আনন্দ মা কে দিতে পেরে আমারও খুব আনন্দ হলো, অনেক দিন পর মনে হলো আমি যেন আমার হারানো জীবন একটু একটু করে খুজে পাচ্ছি। আমাদের পুরো পরিবারটার মাঝে একটাই শূণ্যতা, ছোট ছোট কিছু বাচ্চা-কাচ্চা থাকলে সেটাও বোধহয় পূরণ হয়ে যেতো। চট্টগ্রাম পৌছানোর পর আমাদের সত্যি কথা বলতে কোন পরিকল্পনা ছিল না। যে কটেজটা ১৫ দিনের জন্য ভাড়া নেয়া হলো, মনে হলো সেটা একাই যথেষ্ট। বিশাল এক পাহাড়ের ওপর ছোট্ট একটা টিলা, তার ওপর ছোট্ট একটা বাড়ি। আমরা পৌছানোর পর সবাই আলোচনা করতে লাগলো এর পর কি করা হবে সেটা নিয়ে। আমি তাদের আলোচনা না শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। চারপাশে সবুজের সমারোহ কিছুটা হলেও আমার একাকীত্ব ঘুচিয়ে দিলো, আর সাথে সাথে আমজাদ আঙ্কেলের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। তিনি আমাকে ভাল ওষুধই দিয়েছেন। ওষুধে বোধহয় কাজ হবে। আমি ঘুরে ঘুরে আশেপাশের গাছপালা গুলো দেখতে থাকি। বন্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা জীবগুলো হয়তো খুব একটা নিয়ম মেনে বড় হয় না, কিন্তু তাদের মাঝে একধরণের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য খেলা করে, কেন জানি তাদের দেখে মনে হয় তারা তাদের সবকিছু নিয়ে অনেক আনন্দে বেচে আছে। আমি কেন জানি সেই আনন্দ উপভোগ করতে পারি না। নিজেকে অসহায় মনে হতে থাকে সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবার জন্য। যখন আমি পাহাড়টার একেবারে কিনারায় এসে দাড়ালাম, নিচের সৌন্দর্য দেখে আরও বেশি পুলকিত বোধ হলো। অনেক অনেক নিচে রাস্তাঘাট, মানুষজন চোখে পড়ল। হঠাৎ একটা অদ্ভূত চিন্তা মাথায় এলো আমার। আমি যদি এখন এই পাহাড় থেকে লাফ দেই, তাহলে তার অনুভূতিটা কেমন হবে? নিশ্চয়ই তখন জীবনটাকে অন্য কোন দিক থেকে দেখতে পাবো! আমার মধ্যে এক ধরণের উত্তেজনা কাজ করতে থাকে। পরক্ষণেই চিন্তাটা বাতিল করে দিতে হলো। কারণ আমার খালাত ভাই পেছনে এসে দাড়িয়েছে। আমাকে এখন ফেরত যেতে হবে। -ভাইয়া, কি দেখছ? ভয় ভয় কন্ঠে বলল দিনার। -নিচের জীবনগুলো দেখছি। বললাম আমি। আমি আরও প্রায় আধঘন্টা দাড়িয়ে থাকলাম। দিনার আমার সাথে সাথে দাড়িয়ে থাকল। কেন থাকল আমি জানি না। আমার প্রতি তার কেন এতো সতর্কতা? কেন এত মমতা। জীবনে অনেক বড় বড় জিনিস নিয়ে হয়তো আমি চিন্তা করেছি, কিন্তু এই ছোটখাট ব্যাপারগুলো মনে হয় আমি কখনোই বুঝতে পারবো না। পরদিন খুব ভোরে উঠে আমি সেই জায়গাটায় চলে আসলাম। আজকে আর আমার সাথে দিনার আসে নি। বাসার সবাই ঘুমিয়ে আছে। আমি ঠিক করলাম আজ সত্যি সত্যি লাফ দেব। লাফ দেয়ার পর কি হবে সেটা আমি জানি না। হয়তো মরেও যেতে পারি, কিন্তু সেটা নিয়ে আমার কেন জানি খুব একটা মাথাব্যাথা হলো না। আমার জীবনের সব অর্থ শেষ হয়ে গেছে। শুধু শুধু এই দেহ নিয়ে পড়ে থেকে কি লাভ? কিনার থেকে পড়ে গেলে আমি পাহাড়ের গায়ে বাড়ি খেতে খেতে পড়ব। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম কিছুদূর দৌড় দিয়ে তারপর লাফ দেব। যেই ভাবা সেই কাজ। কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম আর দৌড় শুরু করার প্রস্তুতি নিলাম। -আপনি কি করছেন? পেছন থেকে একটা মিষ্টি কন্ঠ বলে উঠল। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ঘুরে দেখলাম একটা মেয়ে বসে আছে একটা বেঞ্চের ওপর, হাতে একটা বই। গায়ের রং বলে দিলো সে এখানে থাকে না, বেড়াতে এসেছে। চোখে চশমা, তারমানে অনেক পড়াশোনা করে, ডাক্তার গোছের কিছু একটা হবে। হাতে কোন আংটি নেই তারমানে এখনো বিয়ে-শাদি হয় নি। আর বাতাসে উড়তে থাকা চুল দেখে বুঝতে পারলাম বেশ শৌখিন। -পাহাড় থেকে লাফ দিচ্ছি। বললাম আমি। -কেন লাফ দিচ্ছেন? -আত্মহত্যা করব, তাই। -কেন আত্মহত্যা করবেন? ভয়ে মেয়েটার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো, সে তার চশমা খুলে ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকায়। দেখে আমি খুব মজা পেলাম। -ফারিয়া চলে গেছে, তাই আমার বেচে থাকার আর কোন কারণ নেই। -ফারিয়া কে? আমার খুব রাগ হলো। -মেডিকেলে পড় কিন্তু এতো গাধা কেন? সব কিছু জিজ্ঞেস করতে হয়? -আপনাকে কে বলল আমি মেডিকেলে পড়ি? -কেউ বলে নি, আমি বুঝে নিয়েছি। এ কথা শুনে মেয়েটা আরো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার যেন চোখের পলকও পড়তে চায় না। -আপনি নিশ্চয়ই মানসিক ভারসাম্যহীন। আমি জীবনে কখনো কোন মানসিক রোগীকে সামনাসামনি দেখি নি। আজ প্রথম দেখলাম। আমি চুপচাপ তার কথা শুনলাম। কেন জানি তার কন্ঠস্বর শুনে আমার খুব ভালো লাগছিল। চশমা খোলার পর তার সুন্দর চোখদুটো আরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আকাশের নীল রঙয়ের জন্য, নাকি তার আইরিশের কারণে, মেয়েটার চোখের রং ছিল নীল। আমি কিছুক্ষণ সেই নীলের মাঝে হারিয়ে গেলাম। সে ই প্রথম নীরবতা ভাঙল। -আমার কি মনে হয় জানেন? -কি মনে হয়? -আপনি লাফ দিতে পারবেন না। -কেন লাফ দিতে পারবোনা? -লাফ দেয়ার আগে আপনার অতীতের সব স্মৃতি মনে হবে, আপনার মা-বাবা-ভাই-বোন সবার কথা মনে হবে। তখন আপনি থেমে যাবেন। -তুমি কি করে বুঝলে? -আমি গল্পে পড়েছি, এমন হয়। তার কথা শুনতে ভালো লাগছিল। আমি আর লাফ দিলাম না। তার পাশে গিয়ে বেঞ্চের ওপর বসে পড়লাম। এখনো সূর্য ঠিকমতো ওঠে নি। -তুমি এত সকালে এখানে কি করছ? -দেখতেই তো পাচ্ছেন বই পড়ছি। বিরক্ত হয়ে বলল মেয়েটা। -তাই বলে এতো সকালে? -এই পরিবেশে বই পড়তে আমার ভীষণ ভালো লাগে। হাসি হাসি মুখ করে বলল সে। আমি যখন অনেক ছোট ছিলাম, তখন আমার বাবা আমাকে এখানে নিয়ে আসতো, আর রঙিন রঙিন ছড়ার বই থেকে ছড়া পড়ে শোনাতো। এখন আমি বড় হয়ে গেছি, আমি এখন নিজে নিজেই আসি। তার এই সব ছেলেমানুষি অর্থহীন কথাবার্তা শুনতে আমার ভালোই লাগছিল। ফারিয়ার অনুভূতিমূলক শিল্পসম্মত কথাগুলোর মতো নয়, একেবারেই আলাদা। তারসাথে অনেক কথা হলো। তার নাম অর্পা। বাবার সাথে থাকে। মা নেই। ছোটবেলায় মারা গেছেন। তার কোন ভাই-বোনও নেই। বাবা সরকারি চাকুরে। তাই খেয়ে-পরে ভালোই থাকে তারা দুজন। পড়ে কলেজ ফার্স্ট ইয়ারে, যদিও দেখে মনে হয় না। কথা শুনে তো আরও মনে হয় না। একা একা বাবার সাথে থাকতে থাকতে তার মধ্যে বাচ্চা ভাবটা রয়েই গেছে। তার সাথে প্রায় ঘন্টাদুয়েক কথা বলার পর আমার খেয়াল হলো: কথা বলতে বলতে আমরা পাহাড়ের ওই বেঞ্চি থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। নিশ্চয়ই এতোক্ষণে আমাকে খোজাখুজি শুরু হয়ে গিয়েছে। আমি তাকে সেদিনের মতো বিদায় জানিয়ে চলে আসলাম। যদিও আসতে খুব একটা ইচ্ছে করছিল না। কটেজে ফিরে দেখি মা-বাবা রীতিমতো কান্নাকাটি শুরু করেছে। আমাকে ফিরে আসতে দেখে সবাই খুব অবাক হলো। দিনার এক কোণে দাড়িয়ে হতবুদ্ধি হয়ে আছে। নিশ্চয়ই সে মনে করেছে আমি লাফ দিয়েছি। আমার খুব হাসি পেল। সবাই নিশ্চয়ই অনেক ভয় পেয়েছে! মা-আপু-ভাবী সবাই আমাকে এসে জড়িয়ে ধরল। আমি কোনমতে তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে ভান করলাম আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। -কি ব্যাপার? কি হয়েছে? দিনার কথা বলল প্রথম। -না মানে, ভাইয়া, বেঞ্চটার কাছে তোমার জুতো জোড়া পেয়েছিলাম তো, ভেবেছি তুমি পাহাড় থেকে লাফ দিয়েছো। খুবই হাসি পেলো আমার। আমি হো হো করে হাসতে থাকলাম। আমার হাসি দেখে মার মুখেও হাসি ফুটল। -আরে, আমি জুতো খুলে হাটতে গিয়েছিলাম। খুব ভালো লাগল হাটতে। ঘাসের ওপর দিয়ে। আপু কাছে এগিয়ে এল। -একা একা হেটেছিস? কেন জানি আমার তাদেরকে অর্পার কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। -না। -তাহলে? -ফারিয়া ছিলো আমার সাথে। সে সবসময় আমার সাথে থাকে। দু’বছর আগের কথা। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি একটা দোকানের চালার নিচে দাড়িয়ে নিজেকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করছিলাম। হঠাৎ করে কোথা থেকে জানি ফারিয়ার উদয় হলো। সে আমার হাত ধরে টান দিয়ে নিয়ে গেলো বৃষ্টির মধ্যে। আর চিৎকার করে বলতে লাগল: বৃষ্টিঝরা মেঘলা দিনে থেকোনাকো তুমি, লুকিয়ে নীরবে। চলো না ভিজে একাকার হই, এই বাদলে… আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কবিতা শুনি আর বৃষ্টিতে ভিজতে থাকি। সাথে সাথে আমার আশেপাশের জগত বদলে যেতে থাকে। যান্ত্রিক পৃথিবীটা যেন অনেক…অনেক দূরে পড়ে থাকে। মনুষ্য পৃথিবীর মাটিতে নেমে আসি শুধু আমরা দুজন… অর্পার সাথে আমি প্রতিদিন কথা বলি। হাটতে হাটতে। তার নাকি এখন কলেজ বন্ধ। সে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার সাথে থাকে। তার ছেলেমানুষি আচরণ আমার সব অপূর্ণতা ঘুচিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে আমি ভুলে যেতে থাকি ফারিয়াকে। তার ওইসব কঠোর শিল্পের কবিতা-গান কেন জানি এখন আর আমার মনে দানা বাধে না। কেন জানি ঘরের বাতি নিভিয়ে ক্লাসিক্যাল মিউজিক শুনতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় একটা ছড়া গান শুনি, অথবা হা-রে-রে-রে-রে-রে করতে করতে নদীতে ঝাপ দেই। অর্পার পাশে বসে আমি নদীতে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা শিখলাম। আমি ঠিকমতো বড়শি সামলাতে পারি না দেখে তার কি হাসি! আমরা নদীর মাছ তাজা আগুনে ঝলসে খেলাম। আর যখন সন্ধ্যে হয়ে এলো, তখন একজন আরেকজনের শরীরে হেলান দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম বিশাল নদীর শতপ্রাণ স্রোতের দিকে। অর্পা তার হাত আমার হাতের ভেতর রেখে শক্ত করে ধরে ছিলো। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। মৃদু কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় যখন ওর ঠাণ্ডা লাগছিল, সে আমার আরও কাছে এসে বসে। ডুবন্ত নদীর বুকে বিলীন হতে থাকা সূর্যের দিকে তাকিয়ে আমি আমার হৃদয়ে অনুভব করি সমস্ত জগতের ভালোবাসা। এ ভালোবাসা আমরা কেউ কাউকে প্রকাশ করি নি, কিন্তু বুঝে নিয়েছি। অর্পা তার নি:সঙ্গ জীবনের সবটুকুই আমার নামে লেখে দিয়েছে। আর আমি, দিকভ্রান্ত এক পথিক, পথ হারিয়ে তার কূলে এসে ভীড়েছি। কে জানতো, জীবন এভাবে বদলে যাবে? অর্পা আমাকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনলো। আমি তখন আবার আগের মতো হাসি, কথা বলি, অনুভূতি প্রকাশ করি। বাচার আকাঙ্খা নিয়ে বেচে থাকা, আর লক্ষ্যহীন বেচে থাকার পার্থক্য আমার চেয়ে ভালো কেউ বুঝতে পারে না। সাথে সাথে আমাদের যাবার দিন ঘনিয়ে আসে। যাবার আগের দিন আমি অর্পার সাথে এ নিযে কথা বললাম। -আমি জানতাম তুমি চলে যাবে। এবং আমি জানি তুমি আর আসবে না। সে দু:খ ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলল। -বিশ্বাস করো, আমি আসবো। তোমাকে আমার জন্য পারমানেন্ট করে নিয়ে যাবো। শুধু কিছুদিন সময় লাগবে। ফাইনাল পরীক্ষা হলেই শেষ। অর্পা কাদতে থাকে। মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে সে কাদতে থাকে। বারবার বলতে থাকে আমি নাকি আসবো না। অর্পা আমাকে যতোটা ভালোবাসে, ফারিয়া কি ঠিক ততোটাই ভালোবেসেছিলো? ভালোবেসে থাকলে সে আমাকে ছেড়ে চলে গেলো কেন? আমি আমার হাত দিয়ে সযত্নে ওর চোখের পানি মুছে দেই। সকালের সূর্যের নরম আলো পড়ে ওর গাল দুটো চিকচিক করতে থাকে। আমি বুঝতে পারি না, কোন ভাগ্যে আমি এই মানবীকে খুজে পেয়েছি। স্বর্গের পরীরা কি এতোটা সুন্দর হয়? এতোটা নিষ্পাপ হয়? এতোটা শুভ্র হয়। আমার কাছে মনে হলো যেন আমি অনন্তকাল বসে বসে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করি। আমি অর্পাকে কাছে টেনে নিয়ে বললাম, -ভালোবাসায় কিছু কষ্ট সহ্য করতেই হয়। এই কয়টা দিন অপেক্ষা করো। তোমার তো ফোন নেই, আমি তোমাকে প্রতি তিন দিনে একটা করে চিঠি লিখবো। কেমন? অর্পা অনেকটা বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। যে আমি বেচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম, সেই আমি সামান্য এক পরীক্ষার উসিলায় কেন তাকে ফেলে চলে যাচ্ছি সে বুঝতে পারে না। তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমি নিজেকেই নিজে বুঝতে পারি না কখনো। আমরা ঢাকায় চলে আসার পর সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে গেল। ভাইয়া-ভাবী সিদ্ধান্ত নিলো তারা আর ফেরত যাবে না। দেশেই থেকে যাবে। আমি ভার্সিটি ফিরে গেলাম। আবারো হলে থাকতে শুরু করলাম। আমার বন্ধু-বান্ধবরা আমাকে দেখে অনেক উৎসব করলো। তবে সবাই খুব অবাক হলো আমি ফোনে কথা বলা বাদ দিয়ে দিয়েছি দেখে। আমি তাদের এই বিস্ময়টুকু উপভোগ করতে লাগলাম। আমি অফ পিরিয়ডে লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়ার নাম করে অর্পাকে চিঠি লিখতাম। তার দেয়া চিঠিগুলো আবার পোস্ট-অফিস থেকে নিয়ে আসতাম। কেউ কখনো জানতে পারলো না, কি গোপন এক ভালোবাসার অদৃশ্য মায়াজালে জড়িয়ে পড়েছি আমি। ফাইনাল পরীক্ষা পাশের পর সবাই আমার বিয়ের কথা বলতে লাগলো। আমি তীব্র আপত্তি জানালাম। মা বললেন, -কেন বিয়ে করবি না? -আমি একজনকে পছন্দ করি। তাকেই বিয়ে করব। -উফ্। কতবার বলেছি ফারিয়া আর ফিরে আসবে না… -ফারিয়া নয়। মেয়েটার নাম অর্পা… আমি মাকে অর্পার ঘটনা খুলে বলি। আমাকে লেখা অর্পার চিঠিগুলো দেখাই। অর্পার ছেলেমানুষ টাইপের হাতের লেখা দেখে আমি নিজের অজান্তেই হেসে ফেলি। মা খুব খুশি হন অবশেষে আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করেছি দেখে। আমি বাবা-মা আর আপু কে নিয়ে রওনা দেই চট্টগ্রামের পথে। অর্পাকে আমি আমার শেষ চিঠিতে জানিয়ে রেখেছি সে কথা- প্রাণপ্রিয় অর্পা, তোমাকে লেখা এটাই হয়তো আমার শেষ চিঠি। আমার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমি বাবা-মা কে নিয়ে তোমার বাবার সাথে দেখা করতে শীঘ্রই আসছি তোমাদের বাসায়। তুমি এই চিঠির কোন উত্তর আমাকে দেবে না। আমি তোমার সাথে সামনাসামনি কথা বলতে চাই। তোমাকে স্পর্শ করে দেখতে চাই আবার। তোমার ভালোবাসায় উন্মত্ত হতে চাই। ইতি- তোমার ভালোবাসার দীপ্ত আমি মনে মনে কল্পনা করে নেই, আমার চিঠি পেয়ে অর্পা নিশ্চয়ই অনেক অনেক চোখের জল ফেলেছে। একটু হেসেছে, আবার কেদেছে। আমার আসার কথা শুনে সে নিশ্চয়ই সুন্দর করে সেজেছে। চুলে একটা হলুদ গোলাপ দিয়েছে, কপালে একটা ছোট্ট টিপ দিয়েছে। হাতে সাদা রঙের কাচের চুড়ি পরেছে। তারপর তাদের দোতলা বাসার জানালার পাশে বসে গেছে আমার প্রতীক্ষায়, যেমনটা সে সবসময় থাকতো। আমাদের গাড়িটা যখন চট্টগ্রাম পৌছাল ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে। সবাই গাড়ির মধ্যেই তাদের রাতের ঘুম সেরে নিয়েছে। আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম এক রাজকন্যাকে। যে তার রাজকুমারের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্চয়ই অর্পাকে আমি তার ঘরের জানালায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখবো! বাসাটা খুজে পেতে একটু সমস্যা হচ্ছিল। আমি আগে ওদের বাসায় গিয়েছি। কিন্তু এখন সবকিছু কেমন জানি অন্যরকম লাগছে। এই রাস্তাটা যেমন হওয়ার কথা, তেমন তো নেই। আমার একটু খটকা লাগল। আমি গাড়ি থেকে নেমে হেটে যেতে লাগলাম। আশেপাশের মানুষকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম, কিন্তু কোন ফল হলো না। যেই পোস্ট অফিস থেকে অর্পার চিঠি আমি পেয়েছি সেই পোস্ট অফিসেও গেলাম। ভদ্রলোক আমার হাতের চিঠি দেখে যারপরনাই অবাক হলো! -এটা কোনভাবেই সম্ভব না। এ চিঠি কখনোই আমাদের অফিস থেকে পোস্ট করা হয়নি। আপনার ভুল হয়েছে। -অসম্ভব। ভুল আপনাদেরই হচ্ছে কোথাও। একটা কলেজপড়ুয়া মেয়ে প্রতি তিনদিন পর পর এখানে আসতো না চিঠি পোস্ট করতে? পোস্ট-মাস্টার তার পজিটিভ পাওয়ারের চশমাটার ফাক দিয়ে আমাকে ভালো করে দেখলেন। তারপর বললেন, -এক সেকেণ্ড দাড়ান। এইতো। এতোক্ষণে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। এটা হতেই পারে না। অর্পা অবশ্যই নিজ হাতে তার চিঠি পোস্ট করেছে। আমার দেরি দেখে বাবা-মাও চলে এসেছে পোস্ট অফিসে। পোস্ট মাস্টার ফিরলেন কিছুক্ষণ পর। তার হাতে অনেকগুলো চিঠি। একটা চিঠির পেছনের অংশ তুলে ধরে তিনি দেখিয়ে বললেন, -এই চিঠিগুলো কি আপনার লেখা? আমি চিঠিগুলো হাতে নিলাম। আমার নিজের হাতের লেখা চিনতে কোনও সমস্যা হলো না। লাইব্রেরিতে বসে বসে আমি অর্পাকে যত চিঠি লিখেছি, সব আছে এখানে। একটা চিঠিও অর্পার হাত পর্যন্ত পৌছায়নি। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। পোস্ট-মাস্টারকে বুঝিয়ে বলতে চাইলাম, -কিন্তু… -দেখুন। যে ঠিকানা এখানে দেয়া হয়েছে, সে ঠিকানা পুরো বাংলাদেশে কোথাও নেই। এই এলাকায় তো নয়ই। আপনি নিশ্চয়ই ঠিকানা লিখতে ভুল করেছেন। -তা কি করে হয়? চিঠির উত্তর যে ঠিকই এসেছে… আমি হতবিহ্বল হয়ে দাড়িয়ে থাকি। বাবা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থাকে। সেই চেয়ে থাকায় নিদারূণ কষ্ট। আমি জানি এরা কেউ এখন আর আমার কথা বিশ্বাস করবে না। আমার খুব দু:খ হয়। খুব দু:খ। অর্পা ঠিকই বলেছিলো। আমি আর কোনদিনই তার কাছে ফিরে আসবোনা। -দীপ্ত। বাসায় চল। আর পাগলামো করিস না। আমার হাত ধরে টান দিলো বাবা। -কি বলছো বাবা? অর্পার এই চিঠিগুলো কি মিথ্যে? সে এত সুন্দর করে এতো চিঠি লিখল, তার অনুভূতিগুলো কি মিথ্যে? আমাকে একটু সুযোগ দাও বাবা, আমি তাকে খুজে বের করে ফেলবো। ঠিক খুজে বের করে ফেলবো, আমাকে একটু সুযোগ দাও বাবা…আমি চিৎকার করে কাদতে থাকি। অবিশ্বাসে লাঞ্ছনায় পড়ার শোকে নয়, নয় চারপাশের মানুষগুলোর অবাক দৃষ্টির কারণে, আমি কাদতে থাকি অর্পাকে হারিয়ে। আমার জীবনের সেই সোনালি ভালোবাসা কেন হারিয়ে গেল? কেন সে আমার জন্য আরো একটু অপেক্ষা করলো না? আমাকে কাদিয়ে এভাবে চলে গিয়ে কি সুখ পেলো সে…. এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি হাসপাতালের বিছানায় শোয়া। আমার চারপাশে খুব বেশি মানুষ নেই। শুধু মাথার কাছে মা বসে বসে আমার মাথায় হাত বুলোচ্ছে। -মা আমার কি হয়েছে? আমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে কেন? -তুই অনেক কষ্ট পেয়েছিস তো! তাই মাথায় আঘাত লেগেছে। ছোট বাচ্চাদের যেভাবে মায়েরা বোঝায় মা ঠিক সেভাবে আমাকে বোঝাল। আমি মায়ের কথা সরল বিশ্বাসে গ্রহণ করলাম। জানালা দিয়ে আপু, ভাইয়া, ভাবী, দুলাভাই, বাবা সবাইকে দেখতে পেলাম। আমি মনে করলাম এক্ষুণি বুঝি তারা সবাই হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকবে। উফ্, মাথায় কী ভীষণ যন্ত্রণা। আমি অর্পার কথা মনে করলাম। আমার মাথায় যন্ত্রণা হলে সে ফু দিয়ে দিতো। কিভাবে জানি যন্ত্রণা সেরে যেতো। আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘরে ঢুকলেন আমজাদ আঙ্কেল। মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু মাথা ঝাকাতেই মা উঠে বেরিয়ে গেলো। এই মুহূর্তে অবশ্য আমার আমজাদ আঙ্কেলকেই বেশি প্রয়োজন। অনেক কিছু জানার আছে আমার। তিনি হয়তো গুছিয়ে বলতে পারবেন। তাকে দেখে আমি উঠে বসতে গেলাম। -উহু। উঠো না। শুয়ে থাকো। অল্পের জন্য বেচে গেছো ইয়াং ম্যান। আঘাতটা গুরুতর ছিলো। সুস্থ হয়ে যাবে দ্রুত। -আমি জানি আমি সুস্থ হবো না। কার জন্য সুস্থ হবো বলুন? প্রথমে ফারিয়া কষ্ট দিয়ে চলে গেলো, এরপর অর্পা। আর সুস্থ হয়ে কি হবে? -সেটা নিয়েই তো কথা বলতে এলাম। প্রথমে আমাকে বলো, তোমার কাছে ফারিয়ার কোন ভিডিও ক্লিপ আছে? অথবা কোন ছবি? আমি স্মৃতি হাতড়াতে থাকি। কিন্তু মনে পড়েনা কোনদিন কোন ছবি তুলেছিলাম কি না। -তেমন কিছু তো মনে পড়ছেনা আঙ্কেল। -হুমম। আমি তোমার বন্ধু মহলের সাথে কথা বলেছি। তারা স্বীকার করেছে কেউ কখনো ফারিয়াকে স্বচক্ষে দেখেনি। শুধু তুমি ছাড়া। আমি একটু চিন্তা করে দেখলাম। আমার কোন বন্ধুর সামনে কোনদিন ফারিয়া যায় নি। তাদের দেখার কথাও না। -এবং, যে জিনিসটা আমাকে সবচেয়ে অবাক করেছে, সেটা তোমার কল লিস্ট। অসংখ্য উইটনেস আছে যারা স্বীকার করেছে তারা তোমাকে রাত ১২ টার পর অনেক সময় ধরে কথা বলতে দেখেছে। কিন্তু তোমার কললিস্ট চেক করে দেখা গেছে তোমার ফোন থেকে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট কথা তুমি বলেছ…তোমার মায়ের সাথে। আমি আঙ্কেলের নিষেধ তোয়াক্কা না করে উঠে বসে পড়লাম। -এটা কি বলছেন আঙ্কেল। তাহলে আমি ফারিয়ার সাথে এত এত ঘন্টা কথা বললাম, সেগুলোর কি হবে? -তুমি কি এখনো বুঝতে পারছোনা ইয়াং ম্যান, ফারিয়া তোমার সৃষ্ট একটা কাল্পনিক চরিত্র ছাড়া আর কিছুই না। তুমি বলেছ ফারিয়া ভার্সিটিতে পড়ে। ভার্সিটিতে পড়ে, ফারিয়া নামের এমন সব মেয়ের খোজ নেয়া হয়েছে। কেউই তোমার ফারিয়ার সাথে মেলে না। তুমি মনে করেছ তুমি ফারিয়ার সাথে কথা বলছ, কিন্তু আসলে সেটা ছিল তোমার সৃষ্টিশীল মস্তিষ্কের… -প্লিজ আঙ্কেল। আমাকে পাগল বানাবেন না। আমি ফারিয়ার সাথে বৃষ্টিতে ভিজেছি, তার হাত ধরে হেটেছি, তার পাশে বসে থেকেছি… আঙ্কেল আমার কথা শুনেছেন বলে মনে হলো না। -ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে একটা ফুল বিক্রি করা মেয়ের সাথে আমার কথা হয়েছিল। তাকে আমি তোমার ছবি দেখিয়েছি। সে তোমাকে চিনতে পেরেছে। এবং সে বলেছে, তুমি নাকি প্রায়ই লেকের পাড়ে বসে থাকতে, আর অদৃশ্য কারো সাথে কথা বলতে, হাসাহাসি করতে। আমি এখনও ভালো করে চিন্তা করতে পারি না। সব রাগ গিয়ে পড়ে ফারিয়ার ওপর। এত্ত করে বললাম একটা ছবি তুলি…এক সেকেণ্ড। মনে পড়লো আমার, আমি ফারিয়ার একটা ছবি তুলেছিলাম। সেটা ওয়াশও করেছি। আঙ্কেলকে বললাম সেটার কথা। -সেটা আমরা পেয়েছি। ছবিতে কি ছিল জানো? কিছুই ছিলো না। ব্ল্যাঙ্ক। জাস্ট একটা রাস্তার ছবি। ভালো করে ভাবো দীপ্ত, মানুষের কল্পনা পারে না এমন কিছু এই জগতে নেই। আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম। জানালা দিয়ে মিষ্টি রোদ এসে বিছানার ওপর পড়ছিল। আমি তা দেখতে থাকি। নিজেকে আসলে আমি কখনোই বুঝতে পারিনি। -তাহলে ফারিয়া কেন হারিয়ে গেল। একটু কেশে নিলেন আমজাদ আঙ্কেল। -আমার মেয়ে, রোদেলা, ব্যাপারটা নিয়ে একটু থিসিস করছে। তুমি আপাতত ঘুমোও। আমি পরে রোদেলার সাথে তোমার কথা বলিযে দেবো। সেও সাইকোলজির স্টুডেন্ট। আমার মনে হয় ও তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। হ্যাভ এ গুড টাইম। আমজাদ আঙ্কেল চলে গেলেন। আমি একে একে সবার সাথে দেখা করে ঘুমিয়ে পড়লাম। ওষুধের ঘুম। কোন স্বপ্ন দেখতে পেলাম না। শুধু মনে হলো কে জানি স্বপ্নে বারবার উকি দিয়ে যাবার চেষ্টা করছে… সেদিন বিকেলে রোদেলার সাথে আমার কথা হলো। রোদেলা দেখতে অনেকটাই অর্পার মতো। সেই চোখে চশমা। মায়াবী চাহনি। প্রথমে দেখে আমি তাকে অর্পা বলে চিৎকার দিয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু তার আচার আচরণ দেখে বুঝতে পারলাম এই মেয়েটি অর্পা নয়। আমি আবার আগের ন্যায় অনুভূতিহীন জড় পদার্থের মতো বসে থাকি। তবে রোদেলার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসি। মেয়েটি খুব সাদাসিধে কথা বলে। বেশি প্যাচঘোচের মধ্যে যায় না। রোদেলা আমাকে বলল, -আমি গত দুই তিন দিন এই ব্যাপারগুলো নিয়ে অনেক রিসার্চ চালিয়েছি। তারপর একটা সাধারণ ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছি। আমি বলছি না আমার ব্যাখ্যা শতভাগ ঠিক। আমি নিজেই ঠিক নিশ্চিত নই। আপনি শুনুন। পছন্দ না হলে বলবেন। আমি মাথা নাড়লাম। আমি মোটামুটি নিশ্চিত সে কি বলবে, তারপরও আমি তার মুখ থেকেই শুনতে চাই। -আপনি একজন অনুভূতিপ্রবণ মানুষ। সবকিছুতে আপনার আবেগ অনুভূতির মাত্রাটা একটু বেশি। তাই আপনার মা যখন আপনার ছোটবেলার সময় চট্টগ্রাম যেতে চেয়ে ইচ্ছে পোষণ করেন, আপনি সেটা খুব ভালোভাবে মনে রাখেন। কিন্তু আপনার ধারণা আপনার এই অনুভূতিগুলো আপনার আশেপাশের মানুষগুলো কখনো বোঝে না। তাই আপনি ধরে নেন আপনার এমন কেউ আছে যে আপনার চেয়েও বেশি শৈল্পিক, বেশি অনুভূতিপ্রবণ। সে আপনাকে বুঝতে পারে। আপনি কি চান, তা জানতে পারে এবং আপনার দু:খ কষ্ট গুলো ভাগ করে নিতে চায়। এভাবেই আপনি সৃষ্টি করেন আপনার কাল্পনিক ভালোবাসার মানুষ “ফারিয়া” কে। আপনি ফোন কানে লাগিয়ে কথা বলেন এবং কল্পনা করে নেন ফারিয়া কি উত্তর দিচ্ছে। আপনার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হলে আপনি মনে করে নেন, ফারিয়া আপনাকে জোর করে ধরে নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজাচ্ছে। সে যেন আপনার কোন সুপিরিয়র, আপনার চেয়েও বেশিকিছু। এতটুকু বলে সে থামে। মেয়েটা আসলেই খুব ব্রিলিয়ান্ট। সে আমাকে সময় দিল জিনিসটা নিয়ে চিন্তা করার। ব্যাপারটাকে গ্রহণ করে নেয়ার। আমি কোন প্রতিযুক্তি দেখাতে পারলাম না। আমার মনে হয় সে যা বলছে সব সত্যি। রোদেলা আবার শুরু করে। -একটা সময় গিয়ে আপনি বুঝতে পারলেন, আপনার উপর তার এই অধিকারত্ব আপনি সহ্য করতে পারছেন না। সবসময় তার কথামতো আপনার চলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু আপনি তাকে তাড়িয়ে দিতে পারেন না। সে আপনারই একটি সত্ত্বা। তাই আপনি ধরে নেন, |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন