ভালোবাসা কেন এত কাঁদায় ?
হল গেটের ঠিক পাশেই মোবাইল রিচার্জের দোকান।
আরিফ ইচ্ছা করলে দু’মিনিটের
মাঝেই টাকাটা ভরে আসতে পারে।
এতে ওর প্রিপারেশনের মোটেও
ক্ষতি হবে না। গত দুই টার্ম পরীক্ষায়
হায়েস্ট জি.পি.এ. পাওয়া আরিফের
সিলেবাস গত রাতেই শেষ। এখন জাস্ট
রিভিশন। কিন্তু গত পরশু
পাওয়া টিউশুনির টাকাটা ওর
ভাংতে ইচ্ছা করছে না। অবশ্য
টাকা রিচার্জ করাটা এমন জরুরী কিছু
না।
ও গতকালই মালিহাকে জানিয়ে দিয়েছে যে,
ও আর নেট ইউজ করবে না। তাই মিগ
চ্যাটিংয়ের ওখানেই ইতি।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া যে কোন ছাত্রের
জন্য ইন্টারনেট কানেকশন টেক্সট
বইয়ের মতই দরকারী অনুষঙ্গ। আরিফ
এতদিন ফ্রেন্ডদের কানেকশন
দিয়ে কোনমতে ম্যানেজ করে নিয়েছে।
কিন্তু এই টার্মে অ্যাসাইনমেন্টের চাপ
ছিল ভয়াবহ। তাই বাধ্য হয়েই গত
চারমাস ধরে ও রবির ১ গিগার
অফারটা ইউজ করছে। মোবাইলে নেট
থাকার একটা বিশাল সুবিধা হল অবসর
সময়ে চ্যাটিং। আরিফ
প্রথমদিকে কৌতুহলবসত অনিয়মিত
ঢুকলেও পরে ওর সাথে পরিচয় হয়
মালিহার। গতকাল ও
মালিহাকে বলেছে যে ও দু’মাস
নেটে আসবে না। কিন্তু কেন যেন ওর
সাথে আবার কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে।
আরিফ ডাইনিংয়ে যায় রাত নয়টায়।
খেয়েই সোজা চলে যায়
মোবাইলে টাকা রিচার্জ করতে।
‘শুধু শুধু এই ৩২০ টাকা রিচার্জ
করলাম। টাকাটা এই মাসে জলেই গেল’-
রুমে ফিরতে ফিরতে মনে মনে কথাগুলো ভাবে ও।
রাত ১২টার দিকে অনলাইন হয় ও। পাঁচ
মিনিট পর ওকে নক করে মালিহা।
মালিহা সবসময়ই অফলাইন থাকে।
আরিফ জাস্ট ‘হ্যাল্লো’ টাইপ
করে অগোছালো টেবিলের বইখাতা একটু
গোছানোর চেষ্টা করে। একটু পর
মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে মালিহার
একগাদা রিপ্লাই।
টেক্সটগুলো পড়ে প্রথমে ওর মেজাজ
বিগড়ে যায়, পরে অপমানিত বোধ করে।
-আমি জানতাম তুমি আবার আসবে।
-ছেলেরা এমনি
-কোন একটা মেয়ের আইডি পেলেই হলো,
তার পিছু সহজে ছাড়ে না
-মেয়েদের সাথে কথা বলার লোভ তুমিও
সামলাতে পারবে না, এটা আমি জানতাম।
লেখাগুলো পড়ে গত পাঁচদিন ধরে মাথায়
লোড করা সলিড স্টেটের সব লেকচার
হঠাত করে হাওয়া হয়ে যায়।
বলে কি মেয়েটা!
মিগে ছেলেরা মেয়ে আই.ডি’র
পেছনে সি.আই.ডি. এর মত লেগে থাকলেও
আরিফ কখনোই সেটা করেনি। ও সবসময়
রুমেই চ্যাট করত। মালিহাই তো ওর
সাথে প্রথম প্রাইভেট চ্যাট করা শুরু
করে। পরে অ্যাড রিকোয়েস্ট পাঠায়।
‘আর এখন কিনা সেই মালিহাই
আমাকে ব্লেইম দিচ্ছে!’- মনটা হঠাত
করে তেঁতো হয়ে যায় আরিফের।
-এমনি আসলাম
-পরশু এক্সাম
-এখন যাই
-বাই
কথাগুলো লিখে আর কোন রিপ্লাই
না দেখেই লগআউট করে ফেলে আরিফ।
নিজের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জাগে মনে।
কো-এডুকেশন স্কুল
কলেজে পড়ুয়া আরিফ কোনদিন কোন
মেয়ের সাথে গায়ে পড়ে কথা বলেনি।
তবে শ্যামলাবর্ণের আকর্ষণীয় চেহারার
আরিফের সাথে যে কেউ ভাব জমানোর
চেষ্টা করেনি তা অবশ্য না।
তবে আরিফ পড়াশোনার বাইরে কখনোই
অন্য কিছু চিন্তা করেনি। কিন্তু
মালিহার সাথে পরিচয় হবার পর
মাঝে মাঝেই ওর
সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হত। তাই
চ্যাটিংযে ও এখন বলতে গেলে নিয়মিত।
‘নাহ, আর কখনোই মিগে আসবো না।
জাস্ট পড়া আর বিকেলে বন্ধুদের
সাথে আবার আড্ডা’- এই
ভেবে ঘড়িতে সাতটা বাজে অ্যালার্ম
দিয়ে একটু তাড়াতাড়িই
ঘুমিয়ে পড়ে আরিফ।
সকাল সাড়ে সাতটা।
মেয়েকে ডাইনিং টেবিলে দেখে একটু
চমকেই ওঠেন মিসেস শীলা রহমান।
ও’তো কখনোই এত সকালে ঘুম
থেকে উঠতে পারে না।
ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর ফাস্ট
ক্লাশ খুব কমই করতে পেরেছে মালিহা।
আজ অবশ্য ঘুম
থেকে উঠতে হয়নি মালিহার। ও সারারাত
জেগেই ছিল। আরিফের সাথে ওই বিহেভের
পর হঠাত করে ওর
চলে যাওয়াতে মনে একটা অপরাধবোধ
কাজ করছে। সারারাত মিগে অনলাইন
হয়েছিল আরিফকে সরি বলার জন্য।
দু’টা মেইলও পাঠিয়েছে। কিন্তু আরিফের
দেখা নেই।
‘আজ শ্যামাকে হাতের কাছে পেয়ে নেই
শুধু। ওর কারনেই কাল আরিফকে ফান
করে কথাগুলো বলতে গেছিলাম’- এই
কথা ভাবতে ভাবতে গাড়ীতে ওঠে মালিহা।
সাড়ে আটটার মধ্যেই পৌছে যায়
চিটাগাং ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ায়।
নয়টা বাজে ক্লাস শেষ
করে হাসতে হাসতে আসে শ্যামা।
-আরে দোস্তো, তুই আজকে এত সকালে!
-আমার সামনে তোর দাত দেখাবি না,
এক ঘুষিতে ভেঙ্গে দেব
-ক্যান দোস্তো, আমি আবার
কি করলাম।
হাসতে হাসতেই উত্তর দেয় শ্যামা।
-কাল রাতে তোর
কথাগুলো আরিফকে বলাতে ও রাগ
করে চলে গেছে
-চলে গেছে! কোথায়? ফ্রান্স
নাকি আমেরিকা?
-একবার কিন্তু বলসি,
ফাজলামো করবি না। আমার মন
সত্যি সত্যি খারাপ
-দোস্তো, ওসব কিছু না। ছেলেগুলি সব
এমনি। বড় বড় কথা বলে আর
মেয়ে দেখলে ছোক ছোক করে।
মিগে সে আবার আসবে, তোর
সাথে কথা বলবে আর কিছুদিনের
মধ্যে তোর ফোন নাম্বার
চেয়ে তোকে প্রেম নিবেদন করবে। আই
ক্যান বেট।
-তুই ওকে চিনিস না। সবাই এক না। ও
খুবই হার্ট হয়েছে। আমি জানি ও আর
আসবে না।
কথাগুলি বলার সময় মালিহার স্বর
চেঞ্জ হয়ে যায়। কান্নাজড়ানো কন্ঠ
শুনে শ্যামা বুঝতে পারে জ্যুয়োলোজি ডিপার্টমেন্টের
তুখোড় বিতার্কিক চিটাগাং ভার্সিটির
পরমা সুন্দরী মালিহা আজানা এক ছেলের
প্রেমে পড়ে গেছে।
‘হায়রে ডিজিটাল সিস্টেম! চিঠির
বদলে এখনকার রোমিও-জুলিয়েট আদান
প্রদান করে টেক্সট মেসেজ’-
শ্যামা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকা মালিহাকে বলে-‘আন্টিকে ফোন
দে। গাড়ি পাঠাতে বল। আজকে আর
ক্লাশ করা দরকার নেই। চল
মার্কেটে যাই।’
আধ ঘন্টার মধ্যেই
গাড়ি চলে আসে ক্যাম্পাসে। মার্কেটের
একেবারে সামনে এসে মালিহার কথায়
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরায় বাসার দিকে।
মালিহার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না।
শ্যামাও আর চাপাচাপি করলো না।
দেড় মাসের ম্যারাথন পরীক্ষা আজ
শেষ। বুয়েটের সবকিছু ভাল লাগলেও
পাঁচটা পরীক্ষা নিতে দেড় মাসের
লম্বা রুটিনটা আরিফের
সবচেয়ে বেশী খারাপ লাগে।
‘অনেকদিন ধরে টিউশ্যুনিতে যাওয়া হয়
না’- এটা ভেবে খেয়েই ছুট লাগায়
ধানমন্ডির দিকে। ইন্টার
পড়ুয়া রনিকে আগামী কয়েকদিন একটু
বেশী করে পড়াতে হবে। সামনে ওর
পরীক্ষা।
আগে টিউশ্যুনিতে আসলে আরিফের
স্টুডেন্টরা যখন অংক কষত
বা পরীক্ষা দিত তখন আরিফের সময়
কাটত মিগে চ্যাটিং করে। কিন্তু ও এখন
আর মিগে লগইন করে না। ওই ঘটনার
রাতেই মিগ সফটওয়্যারটাও রিমুভ
করে ফেলেছে। ও এখনো ভেবে পায়
না মেয়েরা কি মনে করে নিজেকে! সব
সময়ই একটা হামবড়া ভাব। রিকশায়
চড়ে এমন একটা ভাব ধরে যেন মনে হয়
আশেপাশের সব ছেলেরা মেয়েটার
দিকে দূরবীন লাগিয়ে তাকিয়ে আছে। আর
ওইসব
দূরবীনআলা পাবলিককে কাচকলা দেখানোর
জন্য মেয়েগুলি তাকিয়ে থাকে আকাশের
দিকে। মার্কেটে ভীড়ের মাঝে হঠাত
ধাক্কা লেগে গেলে পেছন
ফিরে এমনভাবে তাকায় যেন মনে হয়
ছেলেগুলি হয়তোবা ধাক্কা লাগানোর
জন্যই মার্কেটে যায়। শহরের ছেলেগুলির
যেন আর কোন কাজ নেই।
-হ্যালো
-হ্যালো স্লামালিক্যুম আন্টি।
আমি শ্যামা। আপনি ভাল আছেন
আন্টি ?
-হ্যা মা, ভাল। লাইনে থাকো।
মালিহাকে ডেকে দিচ্ছি।
মালিহা আনিচ্ছা সত্বেও মায়ের
ডাকে বিকেলের ঘুম ঢুলুঢুলু চোখে ফোন
ধরে।
-হ্যালো
-হ্যালো দোস্তো। তোর জন্য
একটা বিশাল খবর আছে।
-কী ?
-ইন্টার
ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং কম্পিটিশনের
প্রাইমারী রাউন্ড আগামী মাসে হবে।
সো গেট রেডি।
-নারে, আমি এতে নাই। শরীরটা ভাল না।
আর ফাস্ট ইয়ারে পড়ে বাংলাদেশের
নামকরা সব ভার্সিটির
সাথে টেক্কা দেয়ার সাধ্য আমার নাই।
শ্যামা বুঝতে পারে আসলে ওর প্রিয়
বান্ধবীর অসুখটা আসলে মনের। ওই
ঘটনার পর থেকেই সবসময়
হাসিখুশিতে উচ্ছল থাকা মালিহা কেমন
যেন মিইয়ে যাচ্ছে। তাই আর
চাপাচাপি করে না।
এক মাস বন্ধের পর আরিফের ক্লাশ শুরু
হয়েছে শনিবার থেকে। ক্লাশের চাপ
এখনো শুরু হয়নি।
রাতে হলবেডে শুয়ে শুয়ে কৌতুহল
নিয়ে টুটুলের মোবাইল
নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। কি যেন
একটা সমস্যা হয়েছে সেটটায়।
ছোটবেলা থেকেই ওর এক অভ্যাস। কোন
কিছু মাথায় ঢুকলে তা সহজে বের হয় না।
কি মনে করে ও ডাউনলোড দেয় মিগ৩৩
সফটওয়্যারটা। ইউজারনেম আর
পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করে প্রায় তিন
মাস পর। খুলেই চমকে যায়।
ইনবক্সে ৩২টা মেইল আর সবগুলোর
সেন্ডার একজন। সেন্ডার
নেইমঃ maliha_ctg
মেইলগুলো চেক
করে বুঝে যে মালিহা প্রায়
প্রতি তিনদিন পরপর একই মেইল
পাঠিয়েছে। আর সবগুলোতে একই টেক্সট
লেখাঃ very very sorry. My
num is 0191……. Plz call
me.
‘ভণিতা করার আর জায়গা পায় না’-
আরিফ মনে মনে ভাবে। তাও মোবাইল
নাম্বারটা টুকে নেয়। কিন্তু ফোন
না করেই টেবিলে বসে পড়ায় মন দেয়।
বৃহস্পতিবার অফডে। আরিফ
বসে আছে শহীদ মিনারে। কায়েস, টুটুল,
রন্টি সবারই আসার কথা। কোন এক
অজানা কারণে সবাই আজ একযোগে লেট।
মোবাইল নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাত
মালিহার নাম্বারটা স্ক্রীণে আসে। কোন
কিছু না ভেবেই আরিফ কল করে ওই
নাম্বাটাতে। কানে লাগিয়ে বসে থাকে।
অপেক্ষা করতে থাকে অ্যারোগেন্ট
একটা কন্ঠের প্রত্যাশায়।
বারান্দায় বসে থাকা মালিহা কল রিসিভ
করে।
-হ্যালো
-হ্যালো, আমি কি মালিহার
সাথে কথা বলছি ?
-জি, আপনি ?
-আমি আরিফ বলছি।
এই কথাটা শোনার সাথে সাথেই
মালিহা কেমন যেন অনুভব করে।
তিনমাস ধরে ও এই কলটার অপেক্ষাই
করছে। কিন্তু আজ কেন যেন ওর হাত-
পা অসাড় হয়ে আসে। ওর
কথাগুলো জড়িয়ে যেতে থাকে।
-তুমি এতদিন কই ছিলা? তুমি জানো,
তোমাকে কত কথা বলার আছে আমার।
-না না, এমনি একটু বিজি ছিলাম।
তাছাড়া পরীক্ষা ছিল তো, তাই।
-আমি খুবই সরি ওইদিনের কথাগুলির
জন্য।Please don’t mind.
-আরে না। ব্যাপার না। আজ
তাহলে রাখি। ফ্রেন্ডদের সাথে একটু
বাইরে যাচ্ছি।
আনিচ্ছা সত্ত্বেও মালিহা বলে-‘ঠিক
আছে, আমি রাতে ফোন দিব।’
আরিফ লাইন কেটে দেয়।
ওই রাতের পর মালিহা-আরিফের
অভিমানের দেয়াল ভেঙ্গে যায়।
অজানা কোন এক মায়ার টানে আরিফ
উন্মুখ থাকে শুধু রাত্রি নামার আশায়।
আর
বাধভাঙ্গা উচ্ছাসে তথা বলতে বলতে মালিহা আরিফকে জাগিয়ে রাখে মাঝরাত
পর্যন্ত। কিন্তু তারপরও এখন সকালের
ক্লাশ করতে কোন
অসুবিধা হয়না মালিহার। প্রতিদিন
সকাল সাতটায় আরিফের কলে ঘুম
ভাঙ্গে ওর। ক্লাশ আর ডিবেট
কম্পিটিশনের ব্যস্ততার ফাকের
সময়টুকু শ্যামার কাছে আরিফের গল্প
করতে করতেই কাটিয়ে দেয়।
শ্যামা মাঝে মাঝে টিপ্পনী কেটে বলে-
‘দোস্তো, তুমি তো আরিফ ভাইয়ের
প্রেমে পুরাই ডুবে গেসো। এটা কিন্তু
সুবিধার লক্ষণ না। এই ধরনের রিলেশন
রিয়েল না। পরে ধোকা খেলে তোর
লাইফটা এলোমেলো হয়ে যাবে’
‘আরিফ মোটেও এমন না’-
কথাটা বলে হাসতে হাসতে ডিবেট
ক্লাবের দিকে হাটা ধরে মালিহা।
আগামী সপ্তাহে ঢাকায় শুরু হবে ফাইনাল
রাউন্ড। তখন প্রথমবারের মত
আরিফের সাথে দেখা হবে।
কথাটা ভাবতেই খুশিতে মন
নেচে ওঠে মালিহার।
‘আমি কিন্তু দেখতে পেত্নীর মত।
অনেকটা শাকচুন্নী টাইপ। তুমি দেখে ভয়
পাবা নাতো ?’-
হাসতে হাসতে বলে মালিহা।
‘আমি তো ভালবেসেছি তোমার মনকে।
শাকচুন্নীর ভেতর যদি এমন সুন্দর
একটা মন থাকে তবে সেই শাকচুন্নীতেই
আমার সই’- কথা ফিরিয়ে দেয় আরিফ।
আরিফ আর মালিহার প্রথম দেখা করার
প্লেস হিসেবে সিলেক্ট হয় মুক্তমঞ্চের
পাশে ডিঙ্গি রেস্টুরেন্ট। ওটা মালিহার
খালার বাসার খুব কাছে। ডিবেট
কম্পিটিশনে এসে মালিহা ঢাকায় ওর ছোট
খালার বাসায় উঠেছে।
সকাল থেকেই শাড়ি পড়ে খুব সুন্দর
করে সাজতে থাকে মালিহা।
হাতে পড়ে লাল চুড়ি। কপালে দেয় লাল
টিপ। বিনা মেকাপেই পরীর মত
লাগা মালিহাকে আজ মনে হয় যেন
স্বর্গের অপ্সরী।
-কিরে, এত সেজে কোথায় যাচ্ছিসরে?
-চ্যাম্পিয়নশীপ সেলিব্রেট করবো খালা।
সবাই আসছে ডিঙ্গিতে।
দুপুরে একসাথে খাবো। খালার চোখের
দিকে না তাকিয়ে খুব
কষ্টে মিথ্যা অংশটুকু বলে মালিহা।
-দাড়া। ড্রাইভারকে গাড়ি বের
করতে বলছি। গাড়ি নিয়ে যা।
-না খালা, হেটে যেতে দু’মিনিটও
লাগবে না। বলেই বেরিয়ে যায় মালিহা।
হল থেকে সাড়ে এগারোটায় বের হয়
আরিফ। প্রথমে যাবে শাহবাগ, সেখান
থেকে তাজা গোলাপের
তোড়া নিয়ে যাবে ওর
জীবনে আসা সুন্দর মনের শাকচুন্নীর
জন্য- ভাবতে ভাবতে রিকশায়
চড়ে আরিফ।
একটা বাজে ওদের দু’জনের দেখা হবার
কথা। এখন বাজে আড়াইটা। আরিফের
মোবাইলটাও বন্ধ। কোনার দিকের ছোট্ট
টেবিলটায় পরীর মত
একটা মেয়েকে একা বসে থাকতে দেখে কৌতুহলী চোখগুলোর
দৃষ্টি মালিহার কাছে অসহ্য লাগছে।
তিনটার
দিকে মালিহা বেরিয়ে আসে রেস্টুরেন্ট
থেকে। থমথমে চেহারায়
মেয়েকে ফিরে আসতে দেখে মা আর
খালা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। মালিহা চুপ
করে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।
প্রায় দু’মাস হতে চলল। আরিফের
সাথে মালিহার কোন যোগাযোগ নেই।
ফোনটা ডি-অ্যাক্টিভেটেড। ইয়াহু, মিগ,
ফেসবুক কোনটাতেই নেই। আরিফের কোন
বন্ধুকেও মালিহা চেনে না যার কাছ
থেকে ওর খবর পাওয়া যেতে পারে।
আবার শুরু হয় মালিহার ছন্দহীন জীবন।
নিয়মিত ভার্সিটি যাওয়া হয়না, করা হয়
না প্রথম ক্লাশগুলোও। ডিবেট ক্লাবেও
কোন অ্যাক্টিভিটি নেই। বিকেলে বিশাল
বাড়ির ছাদে একা দাড়িয়ে থাকে।
হাতে থাকে মোবাইল।
আজও মালিহা দাড়িয়ে আছে ছাদে।
ঠান্ডা বাতাসে এলোমেলো উড়ছে মালিহার
চুল। দু-এক ফোটা করে বৃষ্টি পড়ছে।
কেন যেন মালিহার মন বলছে আজ
আরিফের ফোন আসবে।
ধীরে ধীরে বৃষ্টির বেগ বাড়ে। বিকেল
গড়িয়ে নামতে থেকে সন্ধ্যার আঁধার।
কিন্তু ফোন আসে না। কেয়ার
কানে বাজে শ্যামার সেই কথা-
‘এই ধরণের রিলেশন রিয়েল না।
পরে ধোকা খেলে তোর
লাইফটা এলোমেলো হয়ে যাবে’
মালিহা কাঁদতে থাকে। আকাশও
বুঝি কাদে আজানা কোন বেদনায়।
মালিহার চোখের পানি একাকার হয়ে যায়
হঠাৎ নামা বর্ষায়। হঠাৎ
আসা অচেনা এক ভালবাসা হারানোর
বেদনা বুঝি ছড়িয়ে পড়ে গোধুলী লগনের
বিষন্ন প্রকৃতিতে।
পরিশিষ্টঃ শাহবাগ থেকে লাল গোলাপের
তোড়া কিনে রাস্তা পার হবার সময়
সড়ক দূর্ঘটনায় মারাত্বক আহত হয়
আরিফ। ঢাকা মেডিকেলে নেবার পথেই
মারা যায় ও। আসরের নামাজের পর
জানাযা শেষে গোধূলী লগনের এই বিষন্ন
ক্ষণেই আজিমপুর গোরস্থানে দাফন
করা হয় আরিফের মরদেহ।
হল গেটের ঠিক পাশেই মোবাইল রিচার্জের দোকান।
আরিফ ইচ্ছা করলে দু’মিনিটের
মাঝেই টাকাটা ভরে আসতে পারে।
এতে ওর প্রিপারেশনের মোটেও
ক্ষতি হবে না। গত দুই টার্ম পরীক্ষায়
হায়েস্ট জি.পি.এ. পাওয়া আরিফের
সিলেবাস গত রাতেই শেষ। এখন জাস্ট
রিভিশন। কিন্তু গত পরশু
পাওয়া টিউশুনির টাকাটা ওর
ভাংতে ইচ্ছা করছে না। অবশ্য
টাকা রিচার্জ করাটা এমন জরুরী কিছু
না।
ও গতকালই মালিহাকে জানিয়ে দিয়েছে যে,
ও আর নেট ইউজ করবে না। তাই মিগ
চ্যাটিংয়ের ওখানেই ইতি।
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া যে কোন ছাত্রের
জন্য ইন্টারনেট কানেকশন টেক্সট
বইয়ের মতই দরকারী অনুষঙ্গ। আরিফ
এতদিন ফ্রেন্ডদের কানেকশন
দিয়ে কোনমতে ম্যানেজ করে নিয়েছে।
কিন্তু এই টার্মে অ্যাসাইনমেন্টের চাপ
ছিল ভয়াবহ। তাই বাধ্য হয়েই গত
চারমাস ধরে ও রবির ১ গিগার
অফারটা ইউজ করছে। মোবাইলে নেট
থাকার একটা বিশাল সুবিধা হল অবসর
সময়ে চ্যাটিং। আরিফ
প্রথমদিকে কৌতুহলবসত অনিয়মিত
ঢুকলেও পরে ওর সাথে পরিচয় হয়
মালিহার। গতকাল ও
মালিহাকে বলেছে যে ও দু’মাস
নেটে আসবে না। কিন্তু কেন যেন ওর
সাথে আবার কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে।
আরিফ ডাইনিংয়ে যায় রাত নয়টায়।
খেয়েই সোজা চলে যায়
মোবাইলে টাকা রিচার্জ করতে।
‘শুধু শুধু এই ৩২০ টাকা রিচার্জ
করলাম। টাকাটা এই মাসে জলেই গেল’-
রুমে ফিরতে ফিরতে মনে মনে কথাগুলো ভাবে ও।
রাত ১২টার দিকে অনলাইন হয় ও। পাঁচ
মিনিট পর ওকে নক করে মালিহা।
মালিহা সবসময়ই অফলাইন থাকে।
আরিফ জাস্ট ‘হ্যাল্লো’ টাইপ
করে অগোছালো টেবিলের বইখাতা একটু
গোছানোর চেষ্টা করে। একটু পর
মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে মালিহার
একগাদা রিপ্লাই।
টেক্সটগুলো পড়ে প্রথমে ওর মেজাজ
বিগড়ে যায়, পরে অপমানিত বোধ করে।
-আমি জানতাম তুমি আবার আসবে।
-ছেলেরা এমনি
-কোন একটা মেয়ের আইডি পেলেই হলো,
তার পিছু সহজে ছাড়ে না
-মেয়েদের সাথে কথা বলার লোভ তুমিও
সামলাতে পারবে না, এটা আমি জানতাম।
লেখাগুলো পড়ে গত পাঁচদিন ধরে মাথায়
লোড করা সলিড স্টেটের সব লেকচার
হঠাত করে হাওয়া হয়ে যায়।
বলে কি মেয়েটা!
মিগে ছেলেরা মেয়ে আই.ডি’র
পেছনে সি.আই.ডি. এর মত লেগে থাকলেও
আরিফ কখনোই সেটা করেনি। ও সবসময়
রুমেই চ্যাট করত। মালিহাই তো ওর
সাথে প্রথম প্রাইভেট চ্যাট করা শুরু
করে। পরে অ্যাড রিকোয়েস্ট পাঠায়।
‘আর এখন কিনা সেই মালিহাই
আমাকে ব্লেইম দিচ্ছে!’- মনটা হঠাত
করে তেঁতো হয়ে যায় আরিফের।
-এমনি আসলাম
-পরশু এক্সাম
-এখন যাই
-বাই
কথাগুলো লিখে আর কোন রিপ্লাই
না দেখেই লগআউট করে ফেলে আরিফ।
নিজের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জাগে মনে।
কো-এডুকেশন স্কুল
কলেজে পড়ুয়া আরিফ কোনদিন কোন
মেয়ের সাথে গায়ে পড়ে কথা বলেনি।
তবে শ্যামলাবর্ণের আকর্ষণীয় চেহারার
আরিফের সাথে যে কেউ ভাব জমানোর
চেষ্টা করেনি তা অবশ্য না।
তবে আরিফ পড়াশোনার বাইরে কখনোই
অন্য কিছু চিন্তা করেনি। কিন্তু
মালিহার সাথে পরিচয় হবার পর
মাঝে মাঝেই ওর
সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হত। তাই
চ্যাটিংযে ও এখন বলতে গেলে নিয়মিত।
‘নাহ, আর কখনোই মিগে আসবো না।
জাস্ট পড়া আর বিকেলে বন্ধুদের
সাথে আবার আড্ডা’- এই
ভেবে ঘড়িতে সাতটা বাজে অ্যালার্ম
দিয়ে একটু তাড়াতাড়িই
ঘুমিয়ে পড়ে আরিফ।
সকাল সাড়ে সাতটা।
মেয়েকে ডাইনিং টেবিলে দেখে একটু
চমকেই ওঠেন মিসেস শীলা রহমান।
ও’তো কখনোই এত সকালে ঘুম
থেকে উঠতে পারে না।
ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর ফাস্ট
ক্লাশ খুব কমই করতে পেরেছে মালিহা।
আজ অবশ্য ঘুম
থেকে উঠতে হয়নি মালিহার। ও সারারাত
জেগেই ছিল। আরিফের সাথে ওই বিহেভের
পর হঠাত করে ওর
চলে যাওয়াতে মনে একটা অপরাধবোধ
কাজ করছে। সারারাত মিগে অনলাইন
হয়েছিল আরিফকে সরি বলার জন্য।
দু’টা মেইলও পাঠিয়েছে। কিন্তু আরিফের
দেখা নেই।
‘আজ শ্যামাকে হাতের কাছে পেয়ে নেই
শুধু। ওর কারনেই কাল আরিফকে ফান
করে কথাগুলো বলতে গেছিলাম’- এই
কথা ভাবতে ভাবতে গাড়ীতে ওঠে মালিহা।
সাড়ে আটটার মধ্যেই পৌছে যায়
চিটাগাং ভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়ায়।
নয়টা বাজে ক্লাস শেষ
করে হাসতে হাসতে আসে শ্যামা।
-আরে দোস্তো, তুই আজকে এত সকালে!
-আমার সামনে তোর দাত দেখাবি না,
এক ঘুষিতে ভেঙ্গে দেব
-ক্যান দোস্তো, আমি আবার
কি করলাম।
হাসতে হাসতেই উত্তর দেয় শ্যামা।
-কাল রাতে তোর
কথাগুলো আরিফকে বলাতে ও রাগ
করে চলে গেছে
-চলে গেছে! কোথায়? ফ্রান্স
নাকি আমেরিকা?
-একবার কিন্তু বলসি,
ফাজলামো করবি না। আমার মন
সত্যি সত্যি খারাপ
-দোস্তো, ওসব কিছু না। ছেলেগুলি সব
এমনি। বড় বড় কথা বলে আর
মেয়ে দেখলে ছোক ছোক করে।
মিগে সে আবার আসবে, তোর
সাথে কথা বলবে আর কিছুদিনের
মধ্যে তোর ফোন নাম্বার
চেয়ে তোকে প্রেম নিবেদন করবে। আই
ক্যান বেট।
-তুই ওকে চিনিস না। সবাই এক না। ও
খুবই হার্ট হয়েছে। আমি জানি ও আর
আসবে না।
কথাগুলি বলার সময় মালিহার স্বর
চেঞ্জ হয়ে যায়। কান্নাজড়ানো কন্ঠ
শুনে শ্যামা বুঝতে পারে জ্যুয়োলোজি ডিপার্টমেন্টের
তুখোড় বিতার্কিক চিটাগাং ভার্সিটির
পরমা সুন্দরী মালিহা আজানা এক ছেলের
প্রেমে পড়ে গেছে।
‘হায়রে ডিজিটাল সিস্টেম! চিঠির
বদলে এখনকার রোমিও-জুলিয়েট আদান
প্রদান করে টেক্সট মেসেজ’-
শ্যামা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকা মালিহাকে বলে-‘আন্টিকে ফোন
দে। গাড়ি পাঠাতে বল। আজকে আর
ক্লাশ করা দরকার নেই। চল
মার্কেটে যাই।’
আধ ঘন্টার মধ্যেই
গাড়ি চলে আসে ক্যাম্পাসে। মার্কেটের
একেবারে সামনে এসে মালিহার কথায়
ড্রাইভার গাড়ি ঘুরায় বাসার দিকে।
মালিহার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না।
শ্যামাও আর চাপাচাপি করলো না।
দেড় মাসের ম্যারাথন পরীক্ষা আজ
শেষ। বুয়েটের সবকিছু ভাল লাগলেও
পাঁচটা পরীক্ষা নিতে দেড় মাসের
লম্বা রুটিনটা আরিফের
সবচেয়ে বেশী খারাপ লাগে।
‘অনেকদিন ধরে টিউশ্যুনিতে যাওয়া হয়
না’- এটা ভেবে খেয়েই ছুট লাগায়
ধানমন্ডির দিকে। ইন্টার
পড়ুয়া রনিকে আগামী কয়েকদিন একটু
বেশী করে পড়াতে হবে। সামনে ওর
পরীক্ষা।
আগে টিউশ্যুনিতে আসলে আরিফের
স্টুডেন্টরা যখন অংক কষত
বা পরীক্ষা দিত তখন আরিফের সময়
কাটত মিগে চ্যাটিং করে। কিন্তু ও এখন
আর মিগে লগইন করে না। ওই ঘটনার
রাতেই মিগ সফটওয়্যারটাও রিমুভ
করে ফেলেছে। ও এখনো ভেবে পায়
না মেয়েরা কি মনে করে নিজেকে! সব
সময়ই একটা হামবড়া ভাব। রিকশায়
চড়ে এমন একটা ভাব ধরে যেন মনে হয়
আশেপাশের সব ছেলেরা মেয়েটার
দিকে দূরবীন লাগিয়ে তাকিয়ে আছে। আর
ওইসব
দূরবীনআলা পাবলিককে কাচকলা দেখানোর
জন্য মেয়েগুলি তাকিয়ে থাকে আকাশের
দিকে। মার্কেটে ভীড়ের মাঝে হঠাত
ধাক্কা লেগে গেলে পেছন
ফিরে এমনভাবে তাকায় যেন মনে হয়
ছেলেগুলি হয়তোবা ধাক্কা লাগানোর
জন্যই মার্কেটে যায়। শহরের ছেলেগুলির
যেন আর কোন কাজ নেই।
-হ্যালো
-হ্যালো স্লামালিক্যুম আন্টি।
আমি শ্যামা। আপনি ভাল আছেন
আন্টি ?
-হ্যা মা, ভাল। লাইনে থাকো।
মালিহাকে ডেকে দিচ্ছি।
মালিহা আনিচ্ছা সত্বেও মায়ের
ডাকে বিকেলের ঘুম ঢুলুঢুলু চোখে ফোন
ধরে।
-হ্যালো
-হ্যালো দোস্তো। তোর জন্য
একটা বিশাল খবর আছে।
-কী ?
-ইন্টার
ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং কম্পিটিশনের
প্রাইমারী রাউন্ড আগামী মাসে হবে।
সো গেট রেডি।
-নারে, আমি এতে নাই। শরীরটা ভাল না।
আর ফাস্ট ইয়ারে পড়ে বাংলাদেশের
নামকরা সব ভার্সিটির
সাথে টেক্কা দেয়ার সাধ্য আমার নাই।
শ্যামা বুঝতে পারে আসলে ওর প্রিয়
বান্ধবীর অসুখটা আসলে মনের। ওই
ঘটনার পর থেকেই সবসময়
হাসিখুশিতে উচ্ছল থাকা মালিহা কেমন
যেন মিইয়ে যাচ্ছে। তাই আর
চাপাচাপি করে না।
এক মাস বন্ধের পর আরিফের ক্লাশ শুরু
হয়েছে শনিবার থেকে। ক্লাশের চাপ
এখনো শুরু হয়নি।
রাতে হলবেডে শুয়ে শুয়ে কৌতুহল
নিয়ে টুটুলের মোবাইল
নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। কি যেন
একটা সমস্যা হয়েছে সেটটায়।
ছোটবেলা থেকেই ওর এক অভ্যাস। কোন
কিছু মাথায় ঢুকলে তা সহজে বের হয় না।
কি মনে করে ও ডাউনলোড দেয় মিগ৩৩
সফটওয়্যারটা। ইউজারনেম আর
পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করে প্রায় তিন
মাস পর। খুলেই চমকে যায়।
ইনবক্সে ৩২টা মেইল আর সবগুলোর
সেন্ডার একজন। সেন্ডার
নেইমঃ maliha_ctg
মেইলগুলো চেক
করে বুঝে যে মালিহা প্রায়
প্রতি তিনদিন পরপর একই মেইল
পাঠিয়েছে। আর সবগুলোতে একই টেক্সট
লেখাঃ very very sorry. My
num is 0191……. Plz call
me.
‘ভণিতা করার আর জায়গা পায় না’-
আরিফ মনে মনে ভাবে। তাও মোবাইল
নাম্বারটা টুকে নেয়। কিন্তু ফোন
না করেই টেবিলে বসে পড়ায় মন দেয়।
বৃহস্পতিবার অফডে। আরিফ
বসে আছে শহীদ মিনারে। কায়েস, টুটুল,
রন্টি সবারই আসার কথা। কোন এক
অজানা কারণে সবাই আজ একযোগে লেট।
মোবাইল নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাত
মালিহার নাম্বারটা স্ক্রীণে আসে। কোন
কিছু না ভেবেই আরিফ কল করে ওই
নাম্বাটাতে। কানে লাগিয়ে বসে থাকে।
অপেক্ষা করতে থাকে অ্যারোগেন্ট
একটা কন্ঠের প্রত্যাশায়।
বারান্দায় বসে থাকা মালিহা কল রিসিভ
করে।
-হ্যালো
-হ্যালো, আমি কি মালিহার
সাথে কথা বলছি ?
-জি, আপনি ?
-আমি আরিফ বলছি।
এই কথাটা শোনার সাথে সাথেই
মালিহা কেমন যেন অনুভব করে।
তিনমাস ধরে ও এই কলটার অপেক্ষাই
করছে। কিন্তু আজ কেন যেন ওর হাত-
পা অসাড় হয়ে আসে। ওর
কথাগুলো জড়িয়ে যেতে থাকে।
-তুমি এতদিন কই ছিলা? তুমি জানো,
তোমাকে কত কথা বলার আছে আমার।
-না না, এমনি একটু বিজি ছিলাম।
তাছাড়া পরীক্ষা ছিল তো, তাই।
-আমি খুবই সরি ওইদিনের কথাগুলির
জন্য।Please don’t mind.
-আরে না। ব্যাপার না। আজ
তাহলে রাখি। ফ্রেন্ডদের সাথে একটু
বাইরে যাচ্ছি।
আনিচ্ছা সত্ত্বেও মালিহা বলে-‘ঠিক
আছে, আমি রাতে ফোন দিব।’
আরিফ লাইন কেটে দেয়।
ওই রাতের পর মালিহা-আরিফের
অভিমানের দেয়াল ভেঙ্গে যায়।
অজানা কোন এক মায়ার টানে আরিফ
উন্মুখ থাকে শুধু রাত্রি নামার আশায়।
আর
বাধভাঙ্গা উচ্ছাসে তথা বলতে বলতে মালিহা আরিফকে জাগিয়ে রাখে মাঝরাত
পর্যন্ত। কিন্তু তারপরও এখন সকালের
ক্লাশ করতে কোন
অসুবিধা হয়না মালিহার। প্রতিদিন
সকাল সাতটায় আরিফের কলে ঘুম
ভাঙ্গে ওর। ক্লাশ আর ডিবেট
কম্পিটিশনের ব্যস্ততার ফাকের
সময়টুকু শ্যামার কাছে আরিফের গল্প
করতে করতেই কাটিয়ে দেয়।
শ্যামা মাঝে মাঝে টিপ্পনী কেটে বলে-
‘দোস্তো, তুমি তো আরিফ ভাইয়ের
প্রেমে পুরাই ডুবে গেসো। এটা কিন্তু
সুবিধার লক্ষণ না। এই ধরনের রিলেশন
রিয়েল না। পরে ধোকা খেলে তোর
লাইফটা এলোমেলো হয়ে যাবে’
‘আরিফ মোটেও এমন না’-
কথাটা বলে হাসতে হাসতে ডিবেট
ক্লাবের দিকে হাটা ধরে মালিহা।
আগামী সপ্তাহে ঢাকায় শুরু হবে ফাইনাল
রাউন্ড। তখন প্রথমবারের মত
আরিফের সাথে দেখা হবে।
কথাটা ভাবতেই খুশিতে মন
নেচে ওঠে মালিহার।
‘আমি কিন্তু দেখতে পেত্নীর মত।
অনেকটা শাকচুন্নী টাইপ। তুমি দেখে ভয়
পাবা নাতো ?’-
হাসতে হাসতে বলে মালিহা।
‘আমি তো ভালবেসেছি তোমার মনকে।
শাকচুন্নীর ভেতর যদি এমন সুন্দর
একটা মন থাকে তবে সেই শাকচুন্নীতেই
আমার সই’- কথা ফিরিয়ে দেয় আরিফ।
আরিফ আর মালিহার প্রথম দেখা করার
প্লেস হিসেবে সিলেক্ট হয় মুক্তমঞ্চের
পাশে ডিঙ্গি রেস্টুরেন্ট। ওটা মালিহার
খালার বাসার খুব কাছে। ডিবেট
কম্পিটিশনে এসে মালিহা ঢাকায় ওর ছোট
খালার বাসায় উঠেছে।
সকাল থেকেই শাড়ি পড়ে খুব সুন্দর
করে সাজতে থাকে মালিহা।
হাতে পড়ে লাল চুড়ি। কপালে দেয় লাল
টিপ। বিনা মেকাপেই পরীর মত
লাগা মালিহাকে আজ মনে হয় যেন
স্বর্গের অপ্সরী।
-কিরে, এত সেজে কোথায় যাচ্ছিসরে?
-চ্যাম্পিয়নশীপ সেলিব্রেট করবো খালা।
সবাই আসছে ডিঙ্গিতে।
দুপুরে একসাথে খাবো। খালার চোখের
দিকে না তাকিয়ে খুব
কষ্টে মিথ্যা অংশটুকু বলে মালিহা।
-দাড়া। ড্রাইভারকে গাড়ি বের
করতে বলছি। গাড়ি নিয়ে যা।
-না খালা, হেটে যেতে দু’মিনিটও
লাগবে না। বলেই বেরিয়ে যায় মালিহা।
হল থেকে সাড়ে এগারোটায় বের হয়
আরিফ। প্রথমে যাবে শাহবাগ, সেখান
থেকে তাজা গোলাপের
তোড়া নিয়ে যাবে ওর
জীবনে আসা সুন্দর মনের শাকচুন্নীর
জন্য- ভাবতে ভাবতে রিকশায়
চড়ে আরিফ।
একটা বাজে ওদের দু’জনের দেখা হবার
কথা। এখন বাজে আড়াইটা। আরিফের
মোবাইলটাও বন্ধ। কোনার দিকের ছোট্ট
টেবিলটায় পরীর মত
একটা মেয়েকে একা বসে থাকতে দেখে কৌতুহলী চোখগুলোর
দৃষ্টি মালিহার কাছে অসহ্য লাগছে।
তিনটার
দিকে মালিহা বেরিয়ে আসে রেস্টুরেন্ট
থেকে। থমথমে চেহারায়
মেয়েকে ফিরে আসতে দেখে মা আর
খালা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। মালিহা চুপ
করে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।
প্রায় দু’মাস হতে চলল। আরিফের
সাথে মালিহার কোন যোগাযোগ নেই।
ফোনটা ডি-অ্যাক্টিভেটেড। ইয়াহু, মিগ,
ফেসবুক কোনটাতেই নেই। আরিফের কোন
বন্ধুকেও মালিহা চেনে না যার কাছ
থেকে ওর খবর পাওয়া যেতে পারে।
আবার শুরু হয় মালিহার ছন্দহীন জীবন।
নিয়মিত ভার্সিটি যাওয়া হয়না, করা হয়
না প্রথম ক্লাশগুলোও। ডিবেট ক্লাবেও
কোন অ্যাক্টিভিটি নেই। বিকেলে বিশাল
বাড়ির ছাদে একা দাড়িয়ে থাকে।
হাতে থাকে মোবাইল।
আজও মালিহা দাড়িয়ে আছে ছাদে।
ঠান্ডা বাতাসে এলোমেলো উড়ছে মালিহার
চুল। দু-এক ফোটা করে বৃষ্টি পড়ছে।
কেন যেন মালিহার মন বলছে আজ
আরিফের ফোন আসবে।
ধীরে ধীরে বৃষ্টির বেগ বাড়ে। বিকেল
গড়িয়ে নামতে থেকে সন্ধ্যার আঁধার।
কিন্তু ফোন আসে না। কেয়ার
কানে বাজে শ্যামার সেই কথা-
‘এই ধরণের রিলেশন রিয়েল না।
পরে ধোকা খেলে তোর
লাইফটা এলোমেলো হয়ে যাবে’
মালিহা কাঁদতে থাকে। আকাশও
বুঝি কাদে আজানা কোন বেদনায়।
মালিহার চোখের পানি একাকার হয়ে যায়
হঠাৎ নামা বর্ষায়। হঠাৎ
আসা অচেনা এক ভালবাসা হারানোর
বেদনা বুঝি ছড়িয়ে পড়ে গোধুলী লগনের
বিষন্ন প্রকৃতিতে।
পরিশিষ্টঃ শাহবাগ থেকে লাল গোলাপের
তোড়া কিনে রাস্তা পার হবার সময়
সড়ক দূর্ঘটনায় মারাত্বক আহত হয়
আরিফ। ঢাকা মেডিকেলে নেবার পথেই
মারা যায় ও। আসরের নামাজের পর
জানাযা শেষে গোধূলী লগনের এই বিষন্ন
ক্ষণেই আজিমপুর গোরস্থানে দাফন
করা হয় আরিফের মরদেহ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন